তুমুল বিতর্কের পর আজ যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের মামলার রায়

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.03.07
BD-warcrimes যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমকে রক্ষার অব্যাহত ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে মশাল মিছিল ও তার ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চ।
বেনার নিউজ

বিচারাধীন মামলা সম্পর্কে যে প্রকাশ্য সমালোচনা ও বিতর্ক হতে পারে, সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার আগে।

ওই মামলা নিয়ে গত তিন দিন ধরে তুমুল বিতর্ক চলেছে এবং এতে অংশ নিয়েছেন সরকারের প্রভাবশালী দুজন মন্ত্রী, অ্যাটর্নি জেনারেল, আইনজ্ঞ, বিরোধী দল বিএনপি ও বিশিষ্ট নাগরিকেরা। সর্বশেষ গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য করায় বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।  

গত শনি ও রোববার প্রধান বিচারপতির ব্যাপক সমালোচনা করে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম দাবি করেছেন, প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন করে মীর কাসেমের মামলাটি পুনঃশুনানি করতে হবে। একইভাবে প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

ওই দুজন মন্ত্রীর এমন বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরক্ত হয়েছেন। তাঁদের উপস্থিতিতে গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিচারাধীন মামলার বিষয়ে কথা বলা তাঁদের কাজ নয়।

মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে গতকাল প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এ প্রসঙ্গে দুই মন্ত্রী যা বলেছেন, তা সরকারের বক্তব্য নয়।

প্রধানমন্ত্রীর এই মনোভাব গতকাল দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর গতকাল এ  নিয়ে সরকারের কোনো মন্ত্রী বা বিচার সংশ্লিষ্ট কেউ কোনো মন্তব্য করেননি।


প্রকাশ্য আলোচনা যেভাবে শুরু

গত শনিবার একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে মীর কাসেম আলীর বিচার ও প্রধান বিচারপতির ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। গত রোববারও আবারও এসব বিষয়ে খোলামেলা বক্তব্য রাখেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।

এর জবাবে একইদিন দুই মন্ত্রীর বক্তব্যকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে মন্তব্য করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আলোচিত ওই মামলার রায় ঘোষণা করবেন। তার আগে প্রধানমন্ত্রী গতকাল সোমবার বলেছেন, একটি সংগঠনের অনুষ্ঠানে গিয়ে দুজন মন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, এতে মনে হয় যেন ওই সংগঠনটি সরকারের কোনো সংগঠন এবং এই বক্তব্য যেন সরকারের বক্তব্য।

তাঁর মতে, এতে কারও কারও ধারণা হতে পারে, সরকারই যেন বিষয়টি আদালতের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তাই একজন মন্ত্রী যা বলতে চান তা ভেবেচিন্তে বলা উচিত।

প্রধানমন্ত্রী এও বলেন, যদি কেউ এ ধরনের বক্তব্য দিতে চান, তাহলে রাস্তায় গিয়ে দেন। মন্ত্রিসভার সদস্য হয়ে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেলেই যা খুশি বলবেন এবং যেকোনো সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কথা বলবেন, এটা ঠিক নয়।


আজ রায়, দুপক্ষই আশাবাদী

প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ আজ এ রায় ঘোষণা করবেন। চলমান এই বিতর্কের মধ্যেই মীর কাসেমের রায় কী হয়, তা জানতে আজ সবার দৃষ্টি সর্বোচ্চ আদালতের দিকে।

গত কয়েক দিনে বিতর্ক ও সমালোচনার অন্যতম লক্ষ্য প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা হলেও রোববার পর্যন্ত তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। সোমবার বিকেলে তিনি দেশে ফিরেছেন।

“বিচারাধীন মামলার বিষয়ে কারও কোনও বক্তব্য দেওয়া উচিত নয়। যারা এমন বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁরা ঠিক করেননি। আশা করব কেউ বিচারাধীন বিষয় নিয়ে বিতর্ক তুলবেন না,” বেনারকে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।


“আশা করি মীর কাসেমের সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকবে,” সাংবাদিকদের জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

তিনি আরও বলেন, সাক্ষ্য ও তথ্যপ্রমাণের ওপর ভিত্তি করে বিচারের রায় হয়। বাইরে কে কী বলল, তা বিবেচনার সুযোগ আদালতের নেই। তাই এসব বক্তব্যের প্রভাব রায়ে পড়ে না।

“আমার বিশ্বাস মীর কাসেম খালাস পাবেন,” বেনারকে জানান মীর কাসেমের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।


মামলার আদ্যোপান্ত

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেমকে ফাঁসির আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর আপিল করেন মীর কাসেম।

২০১২ সালের ১৭ জুন মীর কাসেমকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে গঠন করা ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে ১০টি প্রমাণিত হয়। এই ১০টির মধ্যে ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে আটজনকে নির্যাতনের পর হত্যার দায়ে তাঁকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। বাকি আটটি (২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০ ও ১৪ নম্বর) অভিযোগে ১৭ জনকে নির্যাতনের দায়ে তাঁকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা মীর কাসেম একাত্তরে ছিলেন দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র সংঘের চট্টগ্রাম শহর শাখার সভাপতি। ট্রাইব্যুনালের রায় অনুসারে, একই সঙ্গে তিনি একাত্তরের কুখ্যাত গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান ছিলেন।

তাঁর নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনায় মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লা এলাকার ডালিম হোটেলে স্থাপিত হয় আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র। একাত্তরের চট্টগ্রামে এই ডালিম হোটেলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ, যার তত্ত্বাবধানে ছিলেন কাসেম আলী।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ডালিম হোটেল মানুষের কাছে পরিচিতি পায় হত্যাপুরী হিসেবে, আর নৃশংসতার জন্য মীর কাসেমের পরিচয় হয় ‘বাঙালি খান’।

মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৭ সালে ইসলামি ছাত্র সংঘ নাম বদল করে ছাত্র শিবির নামে রাজনীতি শুরু করে। মীর কাসেম ছিলেন ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ওই সময় থেকে তিনি জামায়াতের রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে দলটির অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্ত করার জন্য উদ্যোগ নিতে শুরু করেন।

এ ছাড়া তিনি দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান, ইবনে সিনা ট্রাস্টের অন্যতম সদস্য। ধীরে ধীরে তিনি জামায়াতের অর্থের অন্যতম জোগানদাতা পরিণত হন।

“মামলাটি এমন একটি পর্যায়ে নেওয়া হয়েছে, যেখানে ফাঁসি বহাল থাকলেও সমালোচনা, না থাকলেও সমালোচনা হবে। এমন সংকট তৈরি করেছেন প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল,” বেনারকে জানান একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির।

তিনি বলেন, দুই মন্ত্রীর বক্তব্যে তিনি কোনো ভুল দেখেন না। কারণ তাঁরা মন্ত্রী হিসেবে বক্তৃতা করেননি। মুক্তিযোদ্ধা, নাগরিক ও বিচারপ্রার্থী হিসেবে তাঁদের কথা বলেছেন।


গণজাগরণ মঞ্চের মশাল মিছিল

যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমকে রক্ষার অব্যাহত ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে মশাল মিছিল ও তার ফাঁসির দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে গণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। সোমবার বিকালে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে এই কর্মসূচি পালন করা হয়।

গণঅবস্থান কর্মসূচিতে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, “মীর কাসেমের বিচার শুরুর পর গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয় যে, মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে এই যুদ্ধাপরাধীকে রক্ষায় লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে। এর প্রতিফলন হিসেবে মীর কাসেমের রায়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি।”

তিনি আরও বলেন, “মীর কাসেম যেহেতু জামাতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়ন্ত্রক, অঢেল সম্পদের মালিক, জনগণের আশঙ্কা ছিল এই সম্পদ বিচারকে বাধাগ্রস্ত করতে ব্যবহৃত হবে।”

বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করার সুযোগ নেই উল্লেখ করে ইমরান এইচ সরকার  বলেন, “মীর কাসেমের অপরাধ নতুন করে প্রমাণ করার কিছু নেই। ট্রাইব্যুনালে সন্দেহাতীতভাবে তার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। আর কালক্ষেপণ না করে আপিল বিভাগে এই রায় বহাল রেখে দ্রুত কার্যকর করতে হবে।”


মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।