বুদ্ধিজীবী হত্যায় মুজাহিদের ফাঁসির দণ্ড বহাল

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.06.16
BD-warcrimes মুজাহিদের ফাঁসির রায় বহাল রাখার খবরে গণজাগরণ মঞ্চ শাহবাগে আনন্দমিছিল করে। ১৬ জুন,২০১৫
বেনার নিউজ

“বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই, অতীতেও ছিল না”—এই দম্ভোক্তি করে সমালোচিত ৭১-এ আলবদর বাহিনীর অন্যতম নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসির সাজা বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্ট।

স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে এই প্রথম একজন যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজা হলো। একইসঙ্গে একজন সাবেক মন্ত্রী ফাঁসিতে ঝুলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী মুজাহিদকে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন তিনি।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায়ে তাঁর সর্বোচ্চ সাজাই প্রাপ্য। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হল, মুজাহিদ যুদ্ধাপরাধী ছিলেন।

রায়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে মুজাহিদের নিজ জেলা ফরিদপুরে আনন্দ মিছিল হয়েছে। বিতরণ করা হয়েছে মিষ্টি, পোড়ানো হয়েছে তাঁর কুশপুত্তলিকা।

“আজ আমার আনন্দের সীমা নেই। আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার এলাকার লোকজনও খুশি ও আনন্দিত। আমাদের দাবি এ রায় দ্রুত কার্যকর হোক,” টেলিফোনে বেনারকে জানান ফরিদপুর শহরের রথখোলা এলাকার মৃত রমেশ চন্দ্র নাথের ছেলে রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথ।মুক্তিযুদ্ধের সময় রনজিৎকে নির্যাতনের দায়ে মুজাহিদকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।

“রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা ও প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মিথ্যা অভিযোগ এনে বানোয়াট সাক্ষী দিয়ে এ রায় দেওয়া হয়েছে,” বেনারের কাছে এমন অভিযোগ করেন ফরিদপুর জেলা জামায়াতের সাবেক আমির বর্তমানে ফরিদপুর অঞ্চলের জামায়াতের নেতা শামসুল ইসলাম।

তাঁর মতে,  এ দেশে যুদ্ধাপরাধী হতে পারে শুধুমাত্র পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনী।’

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আগমুহূর্তে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার নীলনকশা হাতে নিয়ে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনা ও গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনী।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ইতিমধ্যেই জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করেছে সরকার।

আর জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন।এবার মুজাহিদের পালা।

“কোনো ব্যক্তি নিজ দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ রায়ে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার বুদ্ধিজীবীদের আত্মা শান্তি পাবে,” রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে এক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি বের হওয়ার পর থেকে রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হবে।

রায়ের প্রতিবাদে বুধবার সকাল ছয়টা থেকে কাল বৃহস্পতিবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টা হরতাল ডেকেছে মুজাহিদের দল জামায়াতে ইসলামী।এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক রয়েছে।

“পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে আমরা পুনর্বিবেচনার আবেদন করব,” রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে ও ন্যায়বিচার না পাওয়ার অভিযোগ তুলে সাংবাদিকদের জানান মুজাহিদের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।

নিয়ম অনুসারে, পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারবেন মুজাহিদ। তাতেও যদি দণ্ড বহাল থাকে, তাহলেও রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ পাবেন তিনি। সাজা কবে ও কীভাবে কার্যকর করা হবে, তা ঠিক করবে সরকার।


এক মিনিটের রায়

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এক মিনিটে সংক্ষিপ্ত রায় পড়ে শোনান।

রায়ে বলা হয়, আপিল আংশিক মঞ্জুর করা হল। আবেদনকারী আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে এক নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হল। ৩, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর অভিযোগে তাঁকে দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল রাখা হল। ৩, ৫ ও ৬ নম্বর অভিযোগে তাঁর সাজা বহাল রাখা হল। ৭ নম্বর অভিযোগে তাঁর সাজা কমিয়ে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হল।

রায় ঘোষণার সময় এজলাসে উপস্থিত ছিলেন মুজাহিদের দুই ছেলে আলী আহমদ তাহকিক ও আলী আহমদ মাবরুর।


সাতটি অভিযোগের পাঁচটি প্রমাণিত

ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদের বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়।

ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র ও সহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাতে মুজাহিদকে ফাঁসি দেন ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিভাগের রায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায়ে ফাঁসি বহাল রেখে সিরাজুদ্দীন হোসেন হত্যাকাণ্ড থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়।

তৃতীয় অভিযোগ ছিল, ১৯৭১ সালের জুন মাসে ফরিদপুরের রথখোলা গ্রামের রণজিৎ নাথকে আটকে রেখে নির্যাতন। এ অভিযোগে মুজাহিদকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।

পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ৩০ আগস্ট নাখালপাড়ার পুরাতন এমপি হোস্টেলে পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বদি, রুমী, জুয়েল, আজাদ, সুরকার আলতাফ মাহমুদ প্রমুখদের হত্যায় প্ররোচনা দেন মুজাহিদ। এ অভিযোগে তাঁকে আজীবন কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।

সপ্তম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ১৩ মে মুজাহিদ ও তাঁর সহযোগীরা ফরিদপুরের সদর থানার বাকচর গ্রামের কয়েকজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে হত্যা করে।এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ সাজা কমিয়ে আজীবন কারাদণ্ড দেন।

এ ছাড়া দ্বিতীয় ও চতুর্থ অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মুজাহিদকে খালাস দেন ট্রাইব্যুনাল। এ দুটি অভিযোগে আপিল করেনি রাষ্ট্রপক্ষ।


বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা

একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা বাস্তবায়নের পুরো চিত্র তুলে ধরা হয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে। এতে বলা হয়, একাত্তরের অক্টোবর পর্যন্ত মুজাহিদ ছিলেন জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র সংঘের সেক্রেটারি, পরে সভাপতি হন। ওই সময়ে ছাত্র সংঘের সদস্যরা আলবদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। ছাত্র সংঘের ঊর্ধ্বতন নেতা হিসেবে আলবদর ও ছাত্র সংঘের ওপর ওপর মুজাহিদের কর্তৃত্ব ছিল। ওই কর্তৃত্ববলে তিনি আলবদর বাহিনীকে দিক নির্দেশনা দিতেন।

রায়ে আরও বলা হয়, একাত্তরে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজ (তৎকালীন ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) ছিল আলবদরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। মুজাহিদের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র ও সহযোগিতায় স্বাধীনতামনা বুদ্ধিজীবীদের বেশির ভাগকে চোখ বেঁধে প্রথমে এখানেই নিয়ে আসত আলবদর সদস্যরা।

নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর এখান থেকেই তাঁদের রায়ের বাজারে ও মিরপুরের শিয়ালবাড়িসহ অন্য বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করা হতো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন এখানেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে মুজাহিদ আলবদর সদস্যদের উদ্দেশ্যে তাঁর শেষ ভাষণ দিচ্ছিলেন।


মুজাহিদের রাজনীতি ও গ্রেপ্তার

২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের এক মামলায় মুজাহিদকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই সময় থেকে তিনি কারাগারে আছেন।
২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হত্যা মামলায়ও বিচারিক আদালতে মুজাহিদের বিচার চলছে।


১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি ফরিদপুরে জন্ম নেওয়া মুজাহিদ স্বাধীনতার পর আড়ালে ছিলেন। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর রাজনীতিতে সক্রিয় হন।

সংসদ সদস্য হতে কয়েকবার প্রার্থী হলেও একবারও ভোটে জিততে পারেননি মুজাহিদ। কিন্তু ২০০১ সালে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করলে জোটসঙ্গী দল জামায়াত থেকে টেকনোক্রেট মন্ত্রী করা হয় তাঁকে।

ফরিদপুর শহরের পশ্চিম খাবাসপুর এলাকার মাওলানা আব্দুর আলী সড়কে  মুজাহিদের বাড়ির সামনে র‍্যাব–পুলিশের পাহারা ছিল কয়েক দিন ধরে। সেখানে মুজাহিদের প্রয়াত ছোট ভাই সাংবাদিক আলী আশরাফ মো. শোয়াবের স্ত্রী ভাতিজা ভুবনে বসবাস করেন।

“আমাদের এখন চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিইবা করার আছে। ৪৫ বছর আগের ঘটনায় ফাঁসি হবে। তখন মুজাহিদ সাহেবের কতইবা বয়স ছিল?” টেলিফোনে প্রশ্ন রাখেন ফাতিমা লুবনা।


মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।