নারী নিপীড়ণ ঠেকাতে ‘প্রীতিলতা ব্রিগেড’, ৮ নিপীড়ক চিহ্নিত, পুরস্কার ঘোষণা
2015.05.18

নারী নিপীড়নকারী হিসেবে আটজনকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ‘প্রীতিলতা ব্রিগেড’ গঠন করেছে ছাত্র ইউনিয়ন। সারাদেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই শাখা গঠন করে নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।
বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে যৌন হয়রানি এবং তার প্রতিবাদ কর্মসূচিতে পুলিশি লাঠিপেটার প্রতিবাদে নতুন কর্মসূচি হিসেবে এই প্রতিরোধ দল গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রীতিলতা ব্রিগেডের নেতৃত্ব দেবেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ‘অগ্নিকণ্ঠী’ও 'স্লোগান কন্যা' খ্যাত লাকী আক্তার।
এদিকে প্রায় একমাস পর বর্ষবরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারী নিপীড়নকারী হিসেবে আটজনকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। একইসঙ্গে তাদেরকে ধরিয়ে দিলে প্রত্যেক নিপীড়নকারীর জন্য এক লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক। অথচ এর কিছুদিন আগেও এ ঘটনাকে ‘৪-৫ জন যুবকের দুষ্টুমি’ বলে বর্ণণা করেছিলেন আইজিপি।
বাংলা নববর্ষের বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন কয়েকজন নারী। নিপীড়নকারীদের ঠেকাতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন শাখার সভাপতি লিটন নন্দীর হাত ভেঙে যায়। ওই ঘটনা পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে জানানো হলেও তারা যথাসময়ে ব্যবস্থা নেননি বলে অভিযোগ উঠে।
সেদিনের ঘটনার পর নারীদের যৌন হয়রানির ঘটনার প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছিল ছাত্র ইউনিয়ন। জড়িতদের গ্রেপ্তার পুলিশি ব্যর্থতার প্রতিবাদে গত ১০ মে বামপন্থি সংগঠনটি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার কার্যালয় ঘেরাও করতে গেলে তাদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়।
সে ঘটনার প্রতিবাদে এবার গঠন হল প্রীতিলতা ব্রিগেড। যারা মূলত নারী নির্যাতেনর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করবে বলে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে শনিবার ঘোষণা করা হয়। এছাড়া নারী নিপীড়নের প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে সোমবার থেকে সারাদেশ থেকে ১০ লাখ মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে নেমেছে সংগঠনটি। ১৫ দিন ব্যাপী চলবে এ স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান।
ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি হাসান তারেক বর্ষবরণের ঘটনাসহ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি যৌন নিপীড়নের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, “গত কয়েকদিনে আরও বেশ কিছু যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। তাই নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রীতিলতা ব্রিগেড গঠন করা হয়েছে। সারাদেশে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রীতিলতা ব্রিগেড গঠন করে নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলব আমরা।”
গণজাগরণ আন্দোলনের সময় স্লোগান দিয়ে সারাদেশে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী লাকী আক্তার। তখন থেকে তাকে ‘অগ্নিকণ্ঠী’ও বলে থাকেন অনেকে।
ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে নেতৃত্বের দিয়েছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। সেই সাহসী নারীর নামেই নামকরণ করা হল প্রীতিলতা ব্রিগেডের।
কিভাবে কাজ করবে এই ব্রিগেড?- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রীতিলতা বিগ্রেড প্রধান লাকি বেনার নিউজকে বলেন, “নারী নির্যাতনের বিষয়ে সমাজে সচেতনতা গড়ে তোলার বিষয়টি নিয়েই মূলত আমরা কাজ করব। যেখানে মনস্তাত্বিক বিষয়ের পাশাপাশি নারীদেরকে আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করা হবে। তাদের শেখানো হবে কিভাবে প্রতিবাদী কণ্ঠে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।”
নারী নির্যাতন বিরোধী গণস্বাক্ষর অভিযানের প্রথম দিনেই তারা ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন বলে জানান ‘অগ্নিকণ্ঠী’ লাকি। তিনি বলেন, ১০ লাখ গণস্বাক্ষর সংগ্রহহের পর আমরা তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করে নারী নিপীড়ন বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানাবো।”
প্রীতিলতা ব্রিগেড গঠনকে সাধুবাদ জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। সারা হোসেন নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বলেন, রাস্তা ঘাটে চলাফেরা করতে গিয়ে নিপীড়নের শিকার হওয়া যেন নিয়মিত রুটিনে পরিণত হয়েছে। ছাত্র ইউনিয়নের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তবে শুধু একটি দল নয়, সকলকে সম্মিলিতভাবে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তবেই সেটা প্রতিরোধ সম্ভব।
নাজমুল হক নামের আরেক শিক্ষার্থী বেনারকে বলেন, “যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েও মেয়েদের চুপ থাকতে দেখেছি। লজ্জায় অনেক সময় তারা প্রতিবাদটিও করতে পারেন না। আশা করি প্রীতিলতা ব্রিগেড তাদেরকে প্রতিবাদী হয়ে ওঠা শেখাবে।”
পহেলা বৈশাখে যৌন হয়রানির সে ঘটনাকে ‘দুষ্টুমি’ বলায় পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হককে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতে আহ্বান জানায় ছাত্র ইউনিয়ন। এর একদিন পরেই আইজিপি আসামি শনাক্ত হওয়ার ঘোষণা দেন।
রোববার পুলিশ সদর দপ্তরে বসে আইজিপি শহিদুল হক বলেন, “পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে ভিডিও ফুটেজ দেখে আটজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে তাদের পরিচয় জানা যাচ্ছে না। তাই তাদের পরিচয় নিশ্চিত হতে সবার সহযোগিতা চেয়েছে পুলিশ।”
তিনি বলেন, “এদের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে, যাতে কেউ তাদের শনাক্ত করতে পারে। যারা খবর দেবেন তাদের পরিচয় গোপন রাখা হবে।”
প্রথমে যৌন হয়রানির ঘটনাকে ‘দুষ্টুমি’ বলে হালকাভাবে নেওয়া, পরে দোষী চিহ্নিত করে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা-এমন দ্বিমুখীতায় প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে পুলিশের ভূমিকা।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম এ প্রসঙ্গে বলেন, পুলিশের সমালোচনা করে বলেন, “পহেলা বৈশাখে ঘটে যাওয়া দুঃখজনক ঘটনা পুলিশের ভূমিকা সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে এ ঘটনাকে কিছু ছেলের ‘দুষ্টুমি’ বলায় এ ব্যাপারে সরকারও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অবশেষে একমাস পরে হলেও পুলিশ আটজন অভিযুক্তের ছবি প্রকাশ করতে পেরেছে। দেখতে হবে এরপর তারা কী করছে। আশা করব সরকারও সেটা জোরালোভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।
তিনি দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার পাশাপাশি পুলিশকেও দায়িত্বশীল হওয়ার আহবান জানান।
বর্ষবরণের দিনের ঘটনায় পুলিশের তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পেলেও এখন পর্যন্ত তাদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পুলিশের করা তদন্ত কমিটিও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। তবে একজনকে তদন্ত শুরুর আগেই কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করা হয়। আর বর্ষবরণের ঘটনার ভিডিও এবং ছবি গণমাধ্যমে এলেও এখন পুলিশ বলছে, নিপীড়নের শিকার নারী বা প্রত্যক্ষদর্শী কারও কাছ থেকে কোনো তথ্য বা সহযোগিতা তারা তদন্তের ক্ষেত্রে পায়নি।
ওই ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে শাহবাগ থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করা হয়। মামলার তদন্তে সহায়তার জন্য পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার ও সহকারী কমিশনারকে প্রধান করে পৃথক কমিটি করা হয়। এখন পর্যন্ত নিপীড়নের শিকার কোনো নারী পুলিশের কাছে সাক্ষ্য দিতে আসেননি। এমনকি পুলিশও লাঞ্ছনার শিকার কোনো নারীর পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি।