সাইকেল বদলে দিচ্ছে ঢাকার নারীদের লাইফ স্টাইল

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.05.22
BD-woman ​ সাইক্লি​স্টের চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সাইকেল র‍্যালী​ অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা থেকে। ১৫ মে ২০১৫
বেনার নিউজ

রাজধানীর বনানী থেকে মহাখালী সড়ক। ট্রাফিক বাতিতে সবুজ সংকেত দেখা গেলেও গাড়িগুলোর নড়া চড়া নেই। জ্যামে থমকে আছে পুরো রাস্তাটি। সেই সঙ্গে জ্যৈষ্ঠের দাবদাহ রাস্তায় আটকে থাকা মানুষগুলোকে আরো অস্থির করে তুলেছে। এমনই সময় অনেকের নজর কাড়ল রাস্তা বাম পাশ দিয়ে যাওয়া এক সাইকেল আরোহী। দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর ফাঁক ফোকর দিয়ে এগিয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়া এই আরোহী একজন নারী বলেই সকলের দৃষ্টিটা বেশ কৌতূহলী বলে মনে হল।

একটু এগিয়ে পরিচিত হতেই জানা গেল, এই আরোহীর নাম ইয়াসমিন আক্তার লিপি। থাকেন লালমাটিয়া এলাকায়। অফিস গুলশানে। বেনারকে তিনি জানালেন, বাসা থেকে অফিসের দুরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। কিছুদিন আগেও বাসই ছিল যাতায়াতের একমাত্র কিন্তু পরিবহন। কিন্তু জ্যামের কারণে এই রাস্তাটুকু যেতে বা আসতে সময় লাগত প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। আর তাই সময় বাঁচাতে সাইকেল হাতে তুলে নেওয়া।

“এখন মাত্র ৩৫ মিনিটেই ১০ কিলোমিটার পথ দিব্যি চলে যাই।”- বেশ তৃপ্তি নিয়েই বললেন লিপি।

শুধু লিপি নয় রাজধানী ঢাকার অনেক মেয়েই এখন সামাজিক বাধা পেরিয়ে পথের সঙ্গী হিসেবে সাইকেলকে বেছে নিয়েছেন। সংখ্যাটা অনেক বেশি না হলেও ক্রমবর্ধমান।

লিপিসহ একাধিক নারী সাইকেল আরোহীরা জানালেন, যানজটের শহরে সাইকেল যেমন সময় বাঁচায় তেমনি যাতায়াত খরচও কমায়। স্বাস্থ্যগত সুবিধা তো আছেই। তবে রাজধানীতে সাইকেল চালাতে গিয়ে ‘মেয়ে’ বলে নানা ধরনের হেনস্তার শিকার হতে হয়। এমনকি অন্যান্য গাড়ির ড্রাইভাররা ইচ্ছে করে রাস্তায় জায়গাও দিতে চায় না। আর কটাক্ষ, বাজে মন্তব্য তো নিত্যসঙ্গী। এসবের অনেকের কারণে পরিবারও সম্মতি দিতে চায় না।

বাংলাদেশের রাজধানীর চিত্র হলেও, গ্রামগুলো এ পরিস্থিতি উতরে গেছে বহু আগেই। গ্রামের মেয়েদেরকে দল বেঁধে সাইকেলে চড়ে দূরের স্কুলে যেতে দেখা যায় নিয়মিতই। এমনকি বিভিন্ন এনজিও’র মাঠকর্মী হিসেবে যারা কাজ করেন সেসব মেয়েদের তো সাইকেল চালানো বাধ্যতামূলক।

গ্রামের মানুষগুলো যখন মেয়েদের সাইকেল চালানোকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে তবে শহুরেরা নয় কেন? প্রশ্ন রেখেছিলাম মিরপুর এলাকার আরেক সাইকেল আরোহী এলিনা তাসমিনের কাছে। তিনি বলেন, “এটা আসলে অভ্যাসের ব্যাপার। রাজধানীর রাস্তায় গাড়ির চাপ থাকায় মেয়েরা কেন ছেলেরোও সাইকেল নিয়ে খুব বেশি নামত না। তবে এখন সে পরিস্থিতি বদলেছে। ছেলেদের পাশাপাশি নারী সাইকেল চালক বেড়েছে। এখনো হয়ত অনেকে মেনে নিতে পারে না, তবে খুব শিগগিরই এ পরিস্থিতি বদলাবে।”  

তবে নারীদের সাইকেল চালানোকে আরো সহজ করে দিয়েছে বিডি সাইক্লিস্টস নামের একটি সংগঠন। সাইকেল রাইডকে জনপ্রিয় করতে কাজ করে যাচ্ছে তারা। সংগঠনটির চার বছরপূর্তি উপলক্ষে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ দিকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে গত ১৫ মে সাইকেল রাইডিংয়ের আয়োজন করে তারা। মাত্র ১৫-২০ জনের একটি দল নিয়ে শুরু হওয়া এই সংগঠনটির সদস্য সংখ্যা এখন ৫২ হাজারেরও বেশি।

জানা গেলে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই দলে নারী সদস্যও বাড়ছে। তাদেরই একজন আফরোজা আলম। পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করেন তিনি। রোজ সাইকেল চালিয়ে উত্তরার বাসা থেকে বারিধারার অফিসে যাওয়া-আসা করেন। তিনি বলেন, “গ্রামাঞ্চলে স্কুলকলেজ দূরে থাকায় মেয়েরা সাইকেলে অভ্যস্ত হয়েছে। ঢাকাতেও আমরা সাইকেলে চড়ে জ্যাম থেকে রেহাই পাচ্ছি, আবার আলাদা করে শরীরচর্চাও করা লাগছে না। সাইক্লিং করেই ওজন কমে যাচ্ছে।”

তবে শুরুটা একদমই মসৃন ছিলনা বলে জানান তিনি। “বাবা-মা, ভাইবোন এমনকি বন্ধু-বান্ধবরাও শুরুতে বাধা দিয়েছিলেন। নানা সমস্যার ভয় দেখিয়েছিলেন। কিন্তু আমি সেসব জয় করতে পেরেছি। আজ আমার দেখাদেখি ছোট বোনও সাইকেলে কলেজে যায়।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময় ছেলেরা সাইকেল চড়লেও মেয়েদের জন্য অনুমতি ছিল না। তবে সে পরিস্থিতিও বদলেছে। অনেক মেয়েই এখন সাইকেলে চড়ে ক্যাম্পাসে যায়।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ফারাহ মুসলিমা বলেন,  ‘মেয়েরা যখন সাইকেল চালান, তখন সবাই অন্যভাবে তাকায়। নানা মন্তব্য ছুঁড়তে থাকে। তবে মেয়েরা বেশি বেশি চালালে সবার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যাবে।’

বিডি সাইক্লিস্টসের অন্যতম সদস্য ফাহমিদা খানম। দুবছর আগে একদিনে ২০০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে তিনি বেশ সাড়া ফেলেছিলেন। তিনিও জানান, গ্রিনরোডের বাসা থেকে বনানী অফিসে যেতে নিত্য দিনের সঙ্গী এই সাইকেল। তাই পাবলিক বাসের ধাক্কা আর পোহাতে হয় না।

তবে নারীদের সাইকেল চড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার অন্যতম পথিকৃত বিডিসাইক্লিস্টের সাবেক মডারেটর নূর-এ-নাজিয়া। তিনি শুরুর দিককার গল্প টেনে বলেন, ‘বছর চারেক আগে আমরা যখন শুরু করি, প্রথম দু-তিন মাস আমি একাই ছিলাম। তারপর একে একে মেয়েরা যুক্ত হতে থাকল। এখন তো দলে এক হাজার সক্রিয় নারী সদস্য রয়েছে।’

‘স্পিক আপ’ বা ‘সরব হও’ স্লোগান নিয়ে বিডি সাইক্লিস্ট এবার চতুর্থ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করল। সে কথা উল্লেখ করে নাজিয়া বলেন, ‘আমরা চুপ করে থাকতে চাই না। আমরা বলি, যেখানে অনিয়ম, সেখানেই সরব হতে হবে।’

তবে সব ছেলেরা শুধু মেয়েদের সাইকলে চালানো দেখে কটুক্তি করেন তেমনটিও নয়। অনেকেই তাদেরকে উৎসাহ দিয়ে থাকেন। তেমনই একজন জামিল আহমেদ।

তিনি বলেন, আমরা ছেলে বন্ধুরা ছুটির দিনে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। সাইক্লিং শেষ করে আড্ডা দিতাম। কিন্তু মেয়ে বন্ধুরা সেটা থেকে বাদ পড়ে যেত। তাই তাদেরকেও উৎসাহী করে তুললাম। এখন তাদের অনেকেই সাইকেল চালাচ্ছে। শুক্রবার সকাল হলেই এখন সবাই মিলে বেরিয়ে পড়ি। বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া-আসা সহ নানা কাজে সময়মত গন্তব্যে পৌঁছুতে আমাদের মত তারাও জ্যামের শহরে সাইকেলকেই ভরসা মানে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।