মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো নিয়ে অনিশ্চয়তা চলছে
2015.11.10

বেসরকারি রপ্তানিকারকদের (জিটুজি প্লাস) যুক্ত করে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের খসড়া অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলেও সেটি শেষ মুহূর্তে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ফলে সহসাই উন্মুক্ত হচ্ছে না দেশটিতে জনশক্তি রপ্তানির প্রক্রিয়া। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজারগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এ খাতটি হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ডঃ আহমাদ জাহিদ হামিদী গত ৪ নভেম্বর সংসদে প্রশ্নোত্তরে বলেন, বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ শ্রমিক আনার ব্যাপারে চুক্তি চূড়ান্ত হয় নি। এটা নির্ভর করছে বাংলাদেশ সরকারের উপর। তিনি বলেন, বাংলাদেশী শ্রমিকরা অন্য দেশের চেয়ে বেশি বিশ্বস্ত ও অনুগত।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে শ্রমিক আনার ব্যাপারে কাজ দেয়া হয়েছে। তারা শ্রমিক আনার কাজ করবে। অনলাইনের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হবে।
উল্লেখ্য, সিনারফ্লক্স নামে যে প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেটির প্রধান বাণিজ্যিক অংশিদার জাহিদ হামিদীর ভাই আব্দুল হাকিম হামিদী। সে ব্যাপারে উপ-প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সমালোচনা রয়েছে।
তবে সিনারফ্লক্স –এর কাজের পদ্ধতি মানতে রাজী নয় বাংলাদেশ সরকার, চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব ঘটার এটিই প্রধান কারণ।
আটকে গেল জিটুজি প্লাস পদ্ধতি
নানা অনিয়ম ও প্রতারণার কারণে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। এরপর ২০১২ সালের নভেম্বরে দুই দেশের মধ্যে জিটুজি পদ্ধতিতে কর্মী নেওয়ার চুক্তি হলে দেশটিতে যাওয়ার জন্য প্রায় ১৪ লাখ ৫০ হাজার লোক নিবন্ধন করেন। কিন্তু গত তিন বছরে মাত্র আট হাজার কর্মীর কর্মসংস্থান হয় দেশটিতে।
এরই মধ্যে চলতি বছরের মে-জুন মাসে সাগরপথে মানব পাচার, গণকবর ও নির্যাতন নিয়ে তীব্র সমালোচনার মধ্যে মালয়েশিয়া তিন বছরে বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ কর্মী নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। প্রথমে প্রক্রিয়াটি বেসরকারি পর্যায়ে (বিজনেস টু বিজনেস পদ্ধতি বা বি টু বি) ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হলেও পরে ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে কর্মী পাঠানোর বিষয়ে একমত হয় দুই দেশ। যে পদ্ধতিতে জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি সরকারের হাতে থাকলেও সরকার চাইলে এ কাজে বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারকদেরও যুক্ত করতে পারবে।
এ বিষয়ে আলোচনার জন্য সম্প্রতি মালয়েশিয়ার একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে সফর করে। দুদেশের প্রতিনিধি দলের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ৪০ হাজার টাকা খরচে বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের যুক্ত করেই মালয়েশিয়াতে কর্মী পাঠানো হবে। এসব কর্মীদের যাবতীয় তথ্য আদান প্রদান হবে অনলাইনের মাধ্যমে। বিষয়টি ‘শিগগিরই মন্ত্রিসভায় তোলা হবে জানিয়ে তখন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছিলেন মন্ত্রীসভা অনুমোদনের পরেই এ বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হবে।
কিন্তু গত সোমবার মন্ত্রীসভায় অনুমোদের বিষয়টি আটকে যায়। উপস্থাপনের পরেও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় জনশক্তি রপ্তানির গুরুত্বপূর্ণ এই খসড়াটি।
এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ায় সমঝোতা স্মারকের খসড়া প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া নিয়েই সংকট
জিটুজি প্লাস পদ্ধতির প্রধান অন্তরায় হিসেবে মালয়েশিয়ার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজ পাওয়াকে দায়ী করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। ‘সিনারফ্লক্স এসডিএন-বিএইচডি’ নামের প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে যোগসাজশের করছে এমন অভিযোগ এনে প্রধানমন্ত্রীর বরাবর চিঠিও দিয়েছে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা)।
গত ১০ অক্টোবর পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, মালয়েশিয়ার এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গুটি কয়েক লাইসেন্সে কাজ করার সুযোগ পাবে। এতে করে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ে একচেটিয়া মুনাফা লোটার ও প্রতারণার অভিপ্রায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
তবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব খন্দকার মো. ইফতেখার হায়দার বায়রার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বেনারকে বলেন, “বিশেষ কোন রিক্রুটিং এজেন্সিকে সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে আমি কিছু জানিনা। তবে সবাই যাতে সমান সুযোগ পায় সে বিষয়ের প্রতি সরকারের নজর আছে।”
এদিকে মন্ত্রীসভায় খসড়াটির অনুমোদন না হওয়া প্রসঙ্গে বায়রা সভাপতি আবুল বাশার বেনারকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী বিষয়টির আরো ভালভাবে খোঁজ খবর নিয়ে চুক্তি করার পক্ষে মত দিয়েছেন বলে জানতে পেরেছি। আশা করি এবার সেই ব্যবস্থাই হবে।”
জানা যায়, গত ২১ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেখানকার বাংলাদেশ হাইকমিশনকে এক চিঠিতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার বিষয়টি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ‘সিনারফ্লক্স এসডিএন-বিএইচডি’ নামের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটির কাজ করার কথা জানায়। একাজে বাংলাদেশে ও মালয়েশিয়ায় সেবাকেন্দ্র চালু করে তারা কর্মীদের মেডিকেল ও নিবন্ধনের কাজ তদারকি ও কর্মীদের ভিসা প্রক্রিয়ার কাজ করবে বলে জানানো হয়। তারাই কর্মীদের পাসপোর্ট সংগ্রহ করে ভিসা স্টিকার অনুমোদনের জন্য মালয়েশিয়া হাইকমিশনে পাঠাবে এবং তা ফেরতও দেবে।
বায়রা সদস্যদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, মালয়েশিয়ার একজন মন্ত্রী এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আরেক ব্যক্তি মালয়েশিয়ার ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে রয়েছেন।
মূলত: এ বিষয়টি নিয়েই দুদেশের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি বিরাজ করছে।
বায়রার সহসভাপতি আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, “পৃথিবীর প্রায় দেড় শতাধিক দেশ বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নিচ্ছে। কিন্তু এভাবে কোন বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয় নি। এখন কেন দিতে হবে। অন্যান্য দেশ যেভাবে শ্রমিক নিচ্ছে বা দিচ্ছে আমরা সেভাবেই শ্রমিক রপ্তানির জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছি”।
হতাশা বৃহত্তম বাজারগুলো ঘিরেও
জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা কারণে সেগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কুয়েত, ইরাক, লিবিয়ার মত শ্রমবাজারগুলো। যার প্রত্যেকটিতে এক সময় বছরে প্রায় লক্ষাধিক বাংলাদেশি কর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ হত। সেগুলো উন্মুক্ত করার কূটনৈতিক নানা প্রচেষ্টা ব্যর্থ প্রায়। নতুন শ্রমবাজার খোঁজার উদ্যোগও সফলতার মুখ দেখেনি। যে কারণে বেসরকারী ভাবে জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রায় ১২০০ রিক্রুটিং এজেন্সির বেশিরভাগই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। আর বিদেশ গমনেচ্ছুকরা ভুগছে চরম হতাশায়।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যূরো (বিএমইটি) সূত্রে জানা যায়, টানা ৭ বছর ধরে বন্ধ থাকা সৌদি আরবের বাজারটিতে সম্প্রতি নারী শ্রমকি পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু সৌদি আরবের অভিযোগ বাংলাদেশ কাঙ্খিত সংখ্যক কর্মী যোগান দিতে পারছে না। পুরুষ কর্মী পাঠানোতেই আগ্রহ বেশি। অবশ্য দেশটিতে পাঠানো নারী কর্মীরা অনেকেই যৌন ও শাররিক নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন। ফলে উন্মুক্ত হলেও সংকট কাটেনি সৌদি শ্রমবাজারের।
গত তিন বছর ধরে বন্ধ আছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাজার। নানা চেষ্টার পরেও যেটা আজও খোলেনি। সরকার পতনের আন্দোলন ও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের কারণে ইরাক ও লিবিয়ায় শ্রমকি পাঠানো বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ। আবার কুয়েতের বাজারটিও বন্ধ প্রায় ৮ বছর ধরে।
এ বিষয়ে বেসরকারিভাবে শ্রমিক রপ্তানিকারকদের প্রতিষ্ঠান বায়রার সিনিয়র সহসভাপতি আলী হায়দার চৌধুরী বেনারকে বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান শ্রমবাজারগুলো বন্ধ রয়েছে। এদের মধ্যে মালয়েশিয়ার বাজারটি উন্মুক্ত হওয়া নিয়ে আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু সেটি আবারও পিছিয়ে যাওয়ায় রপ্তানিকারক এবং বিদেশ গমনেচ্ছুকদের মাঝে আবারও হতাশা ভর করেছে। শ্রমবাজারগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশের প্রায় ১২০০ রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে মাত্র গোটা পঞ্চাশেক বাদে বাকিগুলো কর্মহীন হয়ে পড়েছে। কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজারগুলো উন্মুক্ত করতে হবে। না হলে সম্ভাবনাময় এই খাত থেকে আসা রেমিটেন্স প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে।”