মাদক নিয়ে বাংলাদেশ–মিয়ানমারের নিষ্ফল আলোচনা চুক্তির দুই দশক পর
2015.05.07

অবৈধ মাদক পাচার বন্ধে দুই দশক আগে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের চুক্তি স্বাক্ষর হয়। সেই চুক্তির আলোকে আলোচনা শুরু হয় দেড়যুগ পর ২০১১ সালে। আর গত চার বছরে ইয়াবা পাচার বন্ধে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে দুই দফা।
দুই দশক ধরে চুক্তি ও আলোচনার এই হাল থেকে বোঝা যায় এর অগগ্রতির চিত্র।
“আপনার সঙ্গে আমার যতো বেশি মুখ দেখাদেখি হবে, ততো আমাদের সম্পর্ক দৃঢ় হবে। আমরা এখন পর্যন্ত কেবল দুইবার মুখোমুখি হয়েছি। আলোচনার ফল পেতে হলে, আলোচনার এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।” আলোচনার ফলাফল জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বজলুর রহমান বেনারকে একথা বলেন।
তবে এবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সরাসরি মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, মিয়ানমারের কিছু প্রভাবশালী ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও ইয়াবা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত।
এ ছাড়া মিয়ানমারের কিছু মাদক পাচারকারীর তালিকা, ৪৫টি ইয়াবা কারখানার ঠিকানা ও বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী মিয়ানমারের নাগরিকদের তালিকা তাদের দেওয়া হয়েছে।
গত ৫ ও ৬ মে ঢাকায় দুই দেশেই মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মধ্যে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা ও সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন।
অন্যদিকে মিয়ানমারের চারজন কর্মকর্তা বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শুধু আশ্বাস দিয়ে মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা।
এ প্রসঙ্গে তাঁদের বক্তব্য ছিল, দেশে গিয়ে উর্ধ্বতন পর্যায়ে আলাপ–আলোচনা করে তাঁরা সিদ্ধান্ত জানাবেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মতে, মেথাএম্ফিটামিন গোত্রের রাসায়নিক উত্তেজক ইয়াবা এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মাদক। অধিদপ্তরের (ডিএনসি) ২০১৩ সালের বার্ষিক মাদক প্রতিবেদনে বলা হয় ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে মাদক হিসেবে ইয়াবার ব্যবহার বেড়েছে ৭৭ গুণ (৭৬২১ শতাংশ)।
মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী মংডুতে বাংলাদেশ সীমান্তের ১০ কিলোমিটারের মধ্যেই অনেকগুলো ইয়াবার কারখানা গড়ে উঠেছে। অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাদক সেবনে বছরে ব্যয় হয় প্রায় চার হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। আর দেশে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ মাদক সেবন করছে।
“এখন বাংলাদেশের মোট মাদকসেবীর ৫০ ভাগের বেশি ইয়াবা ব্যবহার করছে। অর্থাৎ এদেশে ইয়াবার বাজার রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার। আর বাংলাদেশে ব্যবহৃত ইয়াবার পুরোটাই আসছে মিয়ানমার থেকে,” বেনারকে জানান অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক আবু তালেব।
ইয়াবার আগ্রাসী বিস্তার রোধে ১৯৯৪ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত মাদকদ্রব্য চোরাচালান প্রতিরোধ চুক্তি অনুযায়ী ২০১১ সালে সরকারের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই বছরের নভেম্বরে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক খন্দকার মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, কোস্টগার্ড, কাস্টমস ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ইয়াঙ্গুনে যান।
ওই বছরের ১৫ ও ১৬ নভেম্বর দুইদিন ব্যাপী আলোচনায় অংশ নেন তাঁরা। আলোচনায় মিয়ানমারের পুলিশ প্রধান মেজর জেনারেল চ চ তুন এর নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেন। আলোচনার পরে ২৫ জন বড় মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে বাংলাদেশ।
ফিরে এসে কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইয়াবা কারখানার তালিকা দেয়ার পর প্রথমে তারা বিষয়টি অস্বীকার করেন। পরে আলোচনা শেষে এরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখার প্রতিশ্রুতি দেন।
মিয়ানমারের কর্মকর্তারা তখন বলেন, ইয়াবার কাঁচা মাল আসে চীন থেকে। এ জন্য তারা চীনের সঙ্গে আলোচনার জন্যও বাংলাদেশকে তাগিদ দেন। তারা উল্টো অভিযোগ করেন, বাংলাদেশ থেকেও প্রচুর পরিমাণ গাঁজা পাচার হচ্ছে মিয়ানমারে।
এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের মে মাসে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (সিসিডিএসি) জয়েন্ট সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কিয়াও উইনের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা আসেন। ৫ ও ৬ মে বাংলাদেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনার টেবিলে মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ইয়াবা উৎপাদন নিযন্ত্রণের আশ্বাস দিলেও তাঁরা কোনো প্রকার চুক্তি বা সমঝোতা স্মারকে সই করেননি। এমনকি আলোচনার পরে অনুষ্ঠিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনেও তাঁরা উপস্থিত ছিলেন না।
আলোচনায় অংশ নেওয়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে একজন অতিরিক্ত পরিচালক জানান, মিয়ানমারের মধ্যম সারির চারজন কর্মকর্তা এসেছিলেন। তাদের পক্ষে কোনো নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত দেওয়া সম্ভব ছিল না।
২০১১ থেকে চলমান আলোচনা কোনো ফল বয়ে আনেনি, এবারের আলোচনায় আদৌ কিছু হবে কী না জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বজলুর রহমান বলেন, “ওষুধ শিল্পে ব্যবহৃত সহজলভ্য কাঁচামাল দিয়ে রান্নাঘরের মতো ছোট্ট ঘরে হাজার হাজার ইয়াবা তৈরি হচ্ছে। ছোট হওয়ায় এগুলো বহন করা সহজ। আবার এগুলো সেবনের সময় কোনো গন্ধ হয় না। তাই মাদকাসক্তদের কাছে এগুলোর চাহিদা বেশি।”
চোরাপথে আসা ইয়াবার চালান দেশের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পারছে না মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীগুলো। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ সরকারের একাধিক সংস্থা কক্সবাজারের ইয়াবা ডিলারদের তালিকা করেছে। মূলত কক্সবাজারের টেকনাফ হয়েই মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ঢুকছে। তবে সেই তালিকা ধরে কোনো অভিযান হয়েছে বলে শোনা যায়নি।
তবে মহাপরিচালক দাবি করেন, গত বছরের ডিসেম্বরে টেকনাফে ‘ক্র্যাশ অপারেশন’ চালিয়ে ২৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এগুলো তালিকা ধরে করা হয়েছে কী না জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, “কিছু তো তালিকার ভিত্তিতে হয়েছে। অন্য মাধ্যম থেকে তথ্য পেয়ে বাকীদের ধরা হয়েছে।”
অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আমির হোসেন বলেন, “আগে শুধু ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকায় ইয়াবার ব্যবহার সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন গ্রামগঞ্জের পান দোকানেও এটি পাওয়া যায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বা শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে এ সমস্যার মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।”
“মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হওয়া সত্ত্বেও গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল ও গোল্ডেন ক্রিসেন্টের মধ্যবর্তী ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ মাদক ব্যবহারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। আমাদের মাদক সমস্যা প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত,” জাতীয় সংসদের অধিবেশনে সম্প্রতি একথা বলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের তিন দিক দিয়ে ভারতের সঙ্গে চার হাজার কিলোমিটার ও দক্ষিণ পূর্ব কোণে মিয়ানমারের সঙ্গে আড়াইশ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত রয়েছে। এ ছাড়াও শহরায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ইন্টারনেট ও আইটি’র ব্যাপক উন্নতি ও ব্যবহার, সামাজিক সচেতনতার অভাব ইত্যাদিকে মাদক সমস্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, শুধু অভিযান পরিচালনা ও মামলা রুজু করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে গণসচেতনতা সৃষ্টি ও সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণের ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন।