ইয়েমেনের ‘মৃত্য ফাঁদ’ থেকে দেশে ফিরলো ২১ বাংলাদেশি

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.04.13
BD-yemen ইয়েমেনে আটকাবস্থা থেকে উদ্ধার পেয়ে দ্বিতীয় দফায় শনিবার জিবুত থেকে দোহার হয়ে ১০ বাংলাদেশি দেশে ফিরে আসলো। ঢাকার হযরত শাহজালাল অান্তর্জাতিক বিমান বন্দরে তোলা ছবি। ১১ এপ্রিল,২০১৫
বেনার নিউজ

মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে একটি দেশ যেন ‘মৃত্যু ফাঁদ’ হয়ে উঠল। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বোমা, বিমান হামলার শব্দ, চারিদিকে ধ্বংসস্তুপ, নারী শিশুসহ মানুষ হত্যা। সব মিলিয়ে ভয়াবহ এক পরিস্থিতি। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইয়েমেন থেকে ফেরা বাংলাদেশি গোলাম মোস্তফা বেনার নিউজের কাছে এভাবে সেখানকার পরিস্থিতির বর্ণনা তুলে ধরেন।

গোলাম মোস্তফাসহ ইয়েমেন থেকে উদ্ধার হওয়া ২১জন বাংলাদেশি দুই দফায় ইতিমধ্যে ঢাকায় ফিরেছেন। শুক্রবার ( ১০ এপ্রিল ) বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে (ফ্লাইট নং-ই কে ৫৮৬)  ঢাকা আসেন ১১ জন। এদের মধ্যে আটজন নারী ও শিশু।

দ্বিতীয় দফায় শনিবার সন্ধ্যায় ৬টা ৪৫ মিনিটে জিবুতি থেকে ফ্লাই দুবাইয়ের এফজেড-৫৮৫ ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন আরো ১০ জন। এর আগে তাদেরকে  ইয়েমেন থেকে আফ্রিকার দেশ জিবুতিতে নেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ৩৬০ জন বাংলাদেশিকে সরিয়ে জিবুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এদের মধ্যে ৩৪০ জন ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ এবং ২০ জন এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটযোগে জিবুতি পৌঁছান।

ঢাকায় ফিরে পেশায় প্রকৌশলী মোস্তফা বেনারকে বলেন, পেশাগত প্রয়োজনে বিভিন্নে দেশে চাকরি করেছি। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে দেশে ফিরেছি। কিন্তু এবারের ফেরা যেন নতুন জীবন নিয়ে ফেরা। মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা।

বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রকল্পে নিয়োগ পেয়ে মাত্র একমাস আগে ইয়েমেন যান এই প্রকৌশলী। শুরুতে দেশটির ইভ প্রদেশে কাজ থাকলেও পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকায় তিনি রাজধানী সানায় ফিরে সাহাবান নামক একটি হোটেলে অবস্থান নেন। সেখান থেকেই দেখেন যুদ্ধের ভয়াবহতা। তিনিই প্রথম ইমেইলের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে ইয়েমেন পরিস্থিতি জানিয়ে সরকারের কাছে উদ্ধার আহবান জানান।

তিনি বলেন, যত দিন যাচ্ছিল যুদ্ধাবস্থা আরো খারাপ হচ্ছিল। দোকান পাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হোটেলগুলোতেও খাবার-দাবার সংকট দেখা দিতে শুরু করে। এমনকি গাড়ি চলাচলের জন্য পেট্রোলও পাওয়া যেত না।

সংগঠিত হতে শুরু করে বাংলাদেশিরা

দেশে ফেরা বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইয়েমেনে অবস্থানকারী বাংলাদেশিদের অধিকাংশেই শ্রমিক এবং তারা অবৈধ। ফলে পুলিশি ঝামেলা এড়াতে কাজের বাইরে খুব বেশি বের হয় না তারা। ফলে কোথায় কোন বাংলাদেশি আছেন তেমন খোঁজ তারা জানত না। প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফার মোবাইল নম্বর ও ইমেইল ঠিকানা বাংলাদেশি গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পর অনেকেই তাকে ফোন করেন। এভাবে ফোন নম্বর আদান প্রদান করে বাংলাদেশিদের একটি গ্রুপ তৈরি হয়, যারা এই পরিস্থিতিতে দেশে ফিরতে চান।

বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে আশ্রয় চাওয়া

মোস্তফা বলেন, ইয়েমেনে বাংলাদেশের কোন দূতাবাস না থাকায় সংগঠিত হয়েও আমরা কারো কাছে আশ্রয় চাইতে পারছিলাম না। পরে সানায় পাকিস্তান, ভারত ও চীনের দূতাবাসে গিয়ে আমাদেরকে নিরাপদে অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ জানাই। তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতি কিংবা নিজেদের নাগরিকদের নিরাপত্তাকে প্রধান্য দিয়ে তারা আমাদেরকে সোহায্য করতে অস্বীকার করে।

জিবুতিতে বাংলাদেশের প্রত্যাবস্যান নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ইয়েমেনে বাংলাদেশের কোন দূতাবাস না থাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসকে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়। গোলাম মোস্তফা বলেন, এরপর থেকে নিয়মিত কাতার থেকে কাছে ফোন করে বাংলাদেশিদের খোঁজ খবর নেওয়া হত। শীঘ্রই তাদেরকে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হবে বলেও আশ্বস্ত করতেন তারা।

এর কদিন পরেই জিবুতিতে প্রত্যাবস্যন নিয়ন্ত্র কক্ষ’ প্রতিষ্ঠা করে দুজন কাউন্সিলর ও দুজন প্রসাশনিক কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়। পরবর্তিতে সোনে যোগ দেন কাতারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল আসহাব উদ্দিন (এনডিসি, পিএসসি)।

আর বুঝি দেখা হবে না প্রিয়জনদের সঙ্গে

ইয়েমেন থেকে ফেরা আরেক বাংলাদেশি আজিজ বলেন, একটি বোমা পড়ত আর আমাদের পাঁচতলা ভবনটি কেঁপে কেঁপে উঠত। মনে হত এই বুঝি আমরাও ভবনটির নিচে পড়লাম। আর বুঝি দেখা হবে না প্রিয় পরিবার, প্রিয় সন্তানদের সঙ্গে। ওদের মুখটি বারবার ভেসে উঠত চোখের সামনে।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইয়েমেনের সানা শহরের একটি হোটেলে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে চাকরি করছিলেন তিনি।

শনিবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে তিনি বেনারকে বলেন, দুই সন্তানকে ছোট্ট রেখে বিদেশে গিয়েছিলাম। আজ তারা অনেক বড় হয়েছে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে তাদেরকে একটি বারের জন্য ছূঁয়ে দেখতে পারিনি। ইয়েমেনে যুদ্ধ শুরু হলে সারাক্ষণ মনে হত এ জীবনে আর বুঝি সন্তানদের সঙ্গে দেখা হবে না।

জিম্মি করার হুমকি হাউথিদের

ইয়েমেনে বিদ্রোহী হাউথিরা বাংলাদেশিহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের জিম্মি করার ভয় দেখাতে থাকে। এ প্রসঙ্গে আজিজ বলেন, রাস্তাঘাটে সশস্ত্র হাউথি বিদ্রোহীদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তারা দ্রুত ইয়েমেন ছাড়া পরামর্শ দিত। ইয়েমেন না ছাড়লে তাদের হাতে জিম্মি হওয়ার ভয় দেখাত। এমনকি আমাদেরকে না রাখার জন্য মালিককেও তারা হুমকি দিয়েছে।

শনিবার ঢাকায় ফেরা বাহ্মনবাড়িয়ার মো. ইয়াসিন বেনারকে বলেন, গত দেড় মাস ধরে কখনো বাসা থেকে বের হতে পারিনি। সর্বক্ষণ রুমের মধ্যে বন্দি ছিলাম। আবার গত দেড়মাস যাবত ব্যাংক, গ্যাস ও পানি বন্ধ। সবকিছু নিয়ে ওটা ছিল এক ভীতিকর পরিবেশ।

ইয়াসিন ইয়েমেনের যুদ্ধাবস্থার বর্ণনা করে বলেন, আমরা যেখানে ছিলাম, তার পাশেই ছিল হুদায়দাহ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সেখানে বোমা মেরে সব কিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। এর পাশে একটি হাসপাতাল এবং একটি কোম্পানীও ছিল। সেসবও বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কয়েকজন ভারতীয় নাগরিক মারা গেছে বলে শুনেছি।

অসীম বন্ধুতা নিয়ে এগিয়ে আসে ভারত

প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা বলেন, বোমার শব্দে রাতে ঘুমাতে পারতাম না। আবার সকাল থেকে বিভিন্ন দূতাবাসে গিয়ে অনুরোধ করতাম আমাদেরকে সাহায্যের জন্য। এমনই এক সময়ে জানতে পারি বাংলাদেশের অনুরোধে ভারত আমাদেরকে উদ্ধার করবে। সেই অনুযায়ী প্রায় ছয়শ জনের একটি তালিকা আমরা কুয়েতে পাঠাই। একই সঙ্গে সানার ভারতীয় দূতাবাসে যোগাযোগ করতে থাকি।

তিনি বলেন, ভারতের বিমানে তাদের নাগরিকদের নেওয়ার পর আসন ফাঁকা থাকলেই অন্যান্যদের ডেকে নেওয়া হত। অথচ পাকিস্তানি বিমান ৭০টি পর্যন্ত ফাঁকা আসন নিয়ে সানা ছাড়লেও কোন বিদেশিকে নেয়নি। শিশুদেরকে কোলে দিয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে ১৭০ জনের আসনে ২০০ জন যাত্রীও বহন করেছে। এমনকি উড়োজাহাজের ক্রু মেম্বারদের আসনগুলোতেও যাত্রী বহন করেছে তারা। অন্য দেশের নাগরিক ভেবে নয় মানুষ ভেবে মানবতা দেখিয়েছে ভারত।

মোস্তাফা বলেন, রাজনৈতিক সম্পর্ক যেমনই থাকুক না কেন জীবন বাঁচানোর জন্য আজীবন দেশটির কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।
গোলাম মোস্তফা আরো বলেন, সানার বাইরের অনেক শহরে এখনো অনেক বাংলাদেশি আছেন। তারা হয়ত এখনো যোগাযোগ করতে পারেন নি। ইয়েমেনের পরিস্থিতি দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব আমাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।
শিয়াপন্থী হাউথি বিদ্রোহীদের দমনের জন্য সৌদি আরবের নেতৃত্বে সুন্নী প্রধান কয়েকটি দেশ ইয়েমেনে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে।  এর মধ্যই আটকা পড়েছে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের প্রবাসীরা।

এদিকে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক জানান,  এ পর্যন্ত ৩৬০ জন বাংলাদেশিকে ইয়েমেন থেকে জিবুতি নিয়ে আসা হয়েছে। এদের মধ্যে নারী ও শিশুসহ দেশে ফিরেছেন ২১ জন। বাকিদেরকে একটি বড় ক্রুজ শিপের মাধ্যমে জিবুতি থেকে ভারতের কেরালার কোচিন বন্দরে নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে। পরবর্তিতে তাদেরকে বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটযোগে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে।

এছাড়া ভারতের বিমানে উদ্ধার কাজ বন্ধ করলেও বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে ইয়েমেন থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের উদ্ধার অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

ইয়েমেনে মোট কতজন বাংলাদেশি আছেন তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইয়েমেনে তিন হাজার ছয়শ বাংলাদেশি গেছেন। অনেক বাংলাদেশি ওমান বা সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য ইয়েমেনকে রুট হিসেবে ব্যবহার করেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।