নিম্ন আদালতের রায় বাতিল,তারেক রহমানের ৭ বছরের জেল

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.07.21
160721-BD-rahman-verdict-620.jpg বিএনপির গুলশান কার্যালয়ের সামনে বিশাল পোস্টারে মা খালেদা জিয়া ও ভাই আরাফাত রহমান কোকোর (মৃত) সাথে তারেক জিয়ার পোষ্টার।
এএফপি

মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় বিচারিক আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পূত্র তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে তাঁকে ২০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান (৫২) ২০০৮ সাল থেকে সপরিবারে যুক্তরাজ্যে রয়েছেন।

বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে বিকল্প ক্ষমতার কেন্দ্র ‘হাওয়া ভবন’ চালু করে তিনি সমালোচিত হন। এদিকে মক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে আপত্তিতর মন্তব্য করার অভিযোগে গণমাধ্যমে তারেকের বক্তব্য প্রকাশ ও প্রচার করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে হাইকোর্ট।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলাসহ তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির অভিযোগে ১৩০টি মামলা রয়েছে। তবে ২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পর এই প্রথম কোনো মামলায় তারেক দোষী সাব্যস্ত হলেন।

বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ফাইল ফটো,  ক্রেডিটঃ ফোকাস বাংলা।

এর আগে তাঁর ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকো মানি লন্ডারিংয়ের আরেকটি মামলায় দণ্ডিত হয়েছিলেন। দণ্ডিত অবস্থায় বিদেশে থাকাকালে গত বছর তিনি মারা যান।

২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩-এর বিচারক মোতাহার হোসেন বিদেশে অবস্থানরত তারেক রহমানকে বেকসুর খালাসের রায় দিয়ে অবসরে যান। এ নিয়ে সরকার ও সরকারি দলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

“আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি যে, বিচারক তখন প্রভাবিত হয়ে রায় দিয়েছিলেন। নইলে তারেকের বেকসুর খালস পাওয়ার কথা নয়,” বেনারকে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে মালয়েশিয়ায় চলে যান বিচারক মোতাহার,এরপর আর দেশে ফিরেননি তিনি। দুদক অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

ওই বিচারক তারেকের বিরুদ্ধে বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি বলে রায়ে উল্লেখ করেন। তবে তারেকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার কথা বলা হয় সেই রায়ে।

সেই বিচার পর্যালোচনা করে প্রায় আড়াই বছর পর উচ্চ আদালত গতকাল বললেন, তারেক রহমান “সচেতনভাবে এই আর্থিক অপরাধের অংশ ছিলেন। তাই তিনি কোনো ধরনের ছাড় পেতে পারেন না।”

রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, “দুঃখের সঙ্গে দেখা যায়, তারেক রহমান এমন একটি রাজনৈতিক শ্রেণির সদস্য, যাঁদের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে দিকনির্দেশনা দেওয়া, অথচ তিনি সচেতনভাবে একটি আর্থিক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। তিনি তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে পরামর্শ মাশুলের নামে নোংরা অর্থ অর্জন করেছেন।”

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয় যে, তারেকের সহযোগী ছিলেন গিয়াসউদ্দিন আল মামুন। এই ধরনের রাজনৈতিক প্রভাবপুষ্ট দুর্নীতি দেশের সুশাসন, টেকসই উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য হুমকি।

গতকালের রায়ে গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সাত বছরের কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। তবে বিচারিক আদালতে মামুনকে দেওয়া ৪০ কোটি টাকার জরিমানা কমিয়ে ২০ কোটি করা হয়েছে।

বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আপিল মঞ্জুর ও গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের আপিল খারিজ করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আমির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেন।

রায়ে হাইকোর্ট আরও বলেন, যেহেতু তারেক রহমান এখন পলাতক, তাই তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার বা আত্মসমর্পণ করার পর দণ্ড কার্যকর হবে। গিয়াসউদ্দিন আল মামুন ২০০৭ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে কারাগারে আছেন।

এই মামলার বিচার করতে গিয়ে মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকায় আরও চারজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। রায়ে বলা হয়, তাঁরাও এই মানি লন্ডারিং প্রক্রিয়ার অংশ ছিলেন এবং পাচার করা অর্থ পেতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করেছিলেন।

তারা হলেন; হোসাফ গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, নির্মাণ কনস্ট্রাকশনের চেয়ারম্যান খাদিজা ইসলাম এবং দুই বিদেশি সাইরি ও মেরিনা জামান।

সিঙ্গাপুরে পাচা হয়েছিল ঘুষের টাকা

২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর তারেক ও মামুনকে আসামি করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলাটি করে দুদক। মামলায় অভিযোগ করা হয়, টঙ্গীতে প্রস্তাবিত ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ নির্মাণ কনস্ট্রাকশন্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ঘুষ নেয় মামুন।

২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ওই টাকা বিভিন্ন পদ্ধতিতে সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংকে মামুনের ব্যাংক হিসাবে পাচার করা হয়। ওই টাকার মধ্যে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা উত্তোলন করে খরচ করেন তারেক রহমান।

২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর ঘোষিত রায়ে তারেক রহমানকে খালাস এবং গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে সাত বছর কারাদণ্ড এবং ৪০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।

পরে ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর তারেক রহমানের খালাসের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন করে দুদক। গত ৪ মে হাইকোর্টে দুটি আপিলের একসঙ্গে শুনানি শুরু হয়, শেষ হয় ১৬ জুন।

রায়ের প্রতিক্রিয়া

বিএনপি এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা এই রায়ের সমালোচনা করেছেন। চট্টগ্রাম আইনজীবীরা গতকাল বিক্ষোভ করেছেন।

রায়ের পর তারেক রহমানের অন্যতম আইনজীবী জয়নুল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা মনে করি, তারেক রহমান ন্যায়বিচার পাননি।’

তারেক রহমানের আরেক আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বেনারকে বলেন, “আমরা স্তম্ভিত, হতবাক। এ মামলায় ট্রায়াল কোর্টে দুদক প্রমাণ দিতে পারেনি যে গিয়াস উদ্দিন মামুন এক টাকাও বিদেশে নিয়েছেন। তারপরও তাঁকে সাজা দিয়েছে, তারেককে খালাস দিয়েছে। কিন্তু আজ আবার তারেককে সাজা দেওয়া হলো।”

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বেনারকে বলেন, “এই রায়ে প্রমাণিত হলো, যে যত বড়ই হোক না কেন, আইন অমান্য করলে তাঁকে আইনের আওতায় আসতে হবে। তারেক-মামুন যে অপরাধ করেছেন, তা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ঘটানো হয়েছে।”

রায়ের পর দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকার নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করছে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এই রায় তারই অংশ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।