পাকিস্তানকে বাদ রেখে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে জোটবদ্ধ করার তৎপরতা

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.10.17
161017-BRICS-BIMSTEC1000.jpg ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ সম্মেলনে বিমসটেক দেশগুলোর প্রধানেরা।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়,বাংলাদেশ।

দ্বিপক্ষীয় তিক্ত সম্পর্কের জের ধরে পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোকে জোটবদ্ধ করার চেষ্টা করছে ভারত। এ ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের আট দেশের সম্মিলিত জোট সার্ককে বাদ দিয়ে বঙ্গোপসাগরভিত্তিক দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর আঞ্চলিক জোট বিমসটেককে বিকশিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

এমনকি বিশ্বের কয়েকটি অঞ্চলের উন্নয়নশীল অথবা সদ্য শিল্পোন্নত পাঁচ দেশের সংঘ ব্রিকসের সঙ্গে বিমসটেকের মেলবন্ধনের তৎপরতাও দেখা গেছে।

ভারতে সদ্য শেষ হওয়া ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ সম্মেলনে দুই সংস্থার মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে নির্দেশনা দেন দেশগুলোর শীর্ষ নেতারা।

তবে সার্কের বিকল্প বিমসটেক হতে পারে না বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা। কোনো একটি দেশকে বাদ দিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদার হয় না বলেও মনে করেন তাঁরা।

তাঁরা বলছেন, দোষত্রুটি থাকলেও ভারতের এই চেষ্টা পাকিস্তানকে একঘরে করতে পারবে না। আগামী ৯ ও ১০ নভেম্বর পাকিস্তানের ইসলামাবাদে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। তবে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সেনা সদর দপ্তরে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় পাকিস্তানকে দায়ী করে সম্মেলনে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানায় ভারত।

বাংলাদেশসহ মোট চারটি সদস্য দেশ নানা কারনে সম্মেলনে যোগ না দেয়ার সিগ্ধান্ত জানালে সম্মেলনটি স্থগিত করা হয়।

এমন অবস্থায় সার্কের পরিবর্তে বিমসটেক নিয়ে ভাবার কথাও উঠে এসেছে ভারতের দিক থেকে। এরই মধ্যে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত ব্রিকস সম্মেলনের সম্প্রসারিত অংশে যোগ দিতে বিমসটেক সদস্যদেশগুলোর সরকার প্রধানকে আমন্ত্রণ জানান আয়োজক দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

সেই ডাকে সাড়া দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য সদস্য দেশের শীর্ষ নেতারা। বিমসটেকের অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলো হলো; মায়ানমার, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, ভুটান ও নেপাল। মালদ্বীপ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান ছাড়া সার্কের বাকি সদস্যরাই এ জোটে রয়েছে।

তবে মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানকে শুরুতে পর্যবেক্ষক ও পরে বিমসটেকের সদস্য করার ভাবনা রয়েছে বলেও জানিয়েছে কূটনৈতিক সূত্র। এর লক্ষ্য পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে বিমসটেক–কে কার্যকর জোট হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা।

১৬ ও ১৭ অক্টোবর ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ সম্মেলন যেন এ অঞ্চলের নেতাদের মিলন মেলায় পরিণত হয়। সম্মেলন থেকে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়নের জন্য ব্রিকস এবং বিমসটেক সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়।

ওই সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানের নাম উল্লেখ না করে প্রতিবেশী দেশটিকে সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর বলে আখ্যা দেন। সারা বিশ্বে জঙ্গিবাদের উত্থানের জন্য প্রতিবেশী একটি দেশকে দায়ী করে ব্রিকস নেতাদের এ বিষয়ে জোরালো নিন্দা করার আহ্বান জানান তিনি।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, রোববার ভারতের গোয়ায় শেষ হওয়া ব্রিকস সম্মেলনের ইশতেহারে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রসঙ্গটি সরাসরি না থাকলেও ভারতসহ ব্রিকস সদস্যদেশে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানানো হয়েছে।

বিমসটেক, সার্কের বিকল্প নয়

এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ডাকে বিমসটেকের সদস্য দেশের শীর্ষ নেতারা ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিলেও এর মধ্য দিয়ে সার্কের গুরুত্ব শেষ হয়ে যায়নি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এতে মূলত: ভারতের নেতৃত্ববাদী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় বলেও অভিমত তাঁদের।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ বেনারকে বলেন, “পাকিস্তানকে পৃথক করার চেষ্টা থেকে বিমসটেকের সদস্যদের আলাদা করে ডেকে নিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এতে ব্রিকস আর বিমসটেক মেল-বন্ধনের চেয়ে এ অঞ্চলে ভারতের নেতৃত্ব প্রকাশ করার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়।”

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, কোনো দেশকে বাদ দিয়ে আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করা সম্ভব  নয়।

এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শমসের মবিন চৌধুরী বেনারকে বলেন, “বিমসটেক কখনো সার্কের বিকল্প হতে পারে না। সার্ক এখন সাময়িক সমস্যার সম্মুখীন, আগেও এমনটি হয়েছিল; তবে এ সমস্যা কেটে যাবে। আর বিমসটেকও নিজের গতিতে চলবে।”

সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানেরও দায়িত্ব রয়েছে জানিয়ে এই কূটনীতিক বলেন, “অন্যান্য সাতটি সদস্য রাষ্ট্র যাতে আগ্রহী হয়ে সার্ক সম্মেলনে অংশ নিতে পারে, সে পরিবেশ সৃষ্টি করা আয়োজক হিসেবে পাকিস্তানের দায়িত্ব।”

ব্রিকস-বিমসটেক সহযোগিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ব্রিকস সদস্যরা নিজেরাই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। তাই এ সহযোগিতা নিয়ে আপাতত আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই।”

সন্ত্রাসবাদে মদদদাতাদের খুঁজে বের করার আহ্বান

এদিকে টেকসই উন্নয়ন ও শান্তির জন্য ব্রিকস এবং বিমসটেক সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের মদদ এবং অর্থদাতাদের খুঁজে বের করার আহ্বান জানান।

ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ শীর্ষ সম্মেলনে ভাষণকালে এই দুই অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা জোটের সদস্যগুলোর মেলবন্ধনের জন্য তিনটি প্রস্তাবনাও রাখেন তিনি।

শেখ হাসিনার দেওয়া পরামর্শগুলো হলো; উন্নতমানের অবকাঠামো নির্মাণে যত্নবান হওয়া; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে উদ্ভাবনী ক্ষমতার বিকাশ করা; আর তৃতীয় ব্রিকস ও বিমসটেক অর্থনৈতিক উন্নয়নে পরস্পরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া।

এ ছাড়া তিনি বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বিকাশে মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল (এফটিএ) গঠনের ওপরও গুরুত্ব দেন।

তিস্তা ইস্যু সমাধান নিয়ে আশ্বাস মোদির

এদিকে বিমসটেক আউটরিচ সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অমীমাংসিত তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যু দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পাশাপাশি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে সহযোগিতা, সার্ক, সীমান্ত সমস্যার মতো বিষয়েও আলোচনা হয়।

এ প্রসঙ্গে দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার ফরিদ হোসেন টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ইস্যুর দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয়েছে। দ্রুত তিস্তা সমস্যা সমাধানে ভারতের পক্ষ থেকে আশ্বাস পাওয়া গেছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।