খাদ্য সংকটে বান্দরবনের জুমচাষিরা
2016.05.27

মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী বান্দরবানের থানচি উপজেলার দুর্গম এলাকায় বসবাসরত জুমচাষিদের খাদ্য সংকট শুরু হয়েছে। আগামী আগস্টে জুমের ধান না পাওয়া পর্যন্ত এ ঘাটতি থাকবে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
দুর্গম পাহাড়ে জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায় জুম চাষ। অতিবৃষ্টির কারণে এ বছর জুম চাষ করতে পারেনি অনেকেই। কেউ কেউ এই চাষ করলেও ফলন ভালো হয়নি। এ কারণে থানচীর দুর্গম ইউনিয়ন রেমাক্রি ও তিন্দুতে বসবাসরত পাহাড়িরা খাদ্যাভাবে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ভাতের চালের সংকট দেখা দেওয়ায় অভাবী উপজাতিরা এখন বুনো আলু, ফলমূল ও পাহাড়ি কলার মোচা খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে না এলে চলতি বর্ষায় খাদ্য সংকট ব্যাপক আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের।
তিন্দু ইউনিয়নে চেয়ারম্যান মংপ্রুঅং মারমা বেনারকে বলেন, তাঁর ইউনিয়নে প্রায় ১২শ পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে ৭০০ পরিবারে অভাব চলছে।দুর্গম পাহাড়ি এই এলাকা চলতি বর্ষায় খাল ও ঝিরিতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কেউ কেউ না খেয়েও মারা যেতে পারে বলেও তাঁর শঙ্কা।
রেমাক্রি ইউনিয়নে ১৩শ পরিবার আছে। এর মধ্যে প্রায় এক হাজার পরিবার জুমিয়া। এঁদের প্রায় সবাই খাদ্যসংকটে পড়েছে বলে জানা যায়।
জেলা প্রশাসনের উদ্যোগ
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানায়, উপজেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে অভাবী পরিবারগুলোর তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
“জুমচাষিরা খাদ্যসংকটে পড়লেও জেলা ও উপজেলার গুদামগুলোতে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। খাদ্যাভাবে পড়া দুই হাজার ৩০০ দরিদ্র জুমিয়া পরিবারের জন্য এ পর্যন্ত ৪৬ টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে,” বেনারকে জানান জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক।তিনি বলেন, ইতিমধ্যে ১৬ টন চাল খাদ্যাভাবে পড়া পরিবারগুলোকে দেওয়া হয়েছে। আরও ৩০ টন চাল দ্রুত পাঠানো হচ্ছে। দুর্গম এলাকাগুলোতে প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে হেলিকপ্টারে খাদ্যশস্য পৌঁছে দেওয়া হবে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।
জেলা প্রশাসক সংবাদ সম্মেলন ডেকে গত বৃহস্পতিবার বলেন, দুর্গম এলাকায় বসবাসরত জুমচাষিরা কিছুদিনের জন্য খাদ্যাভাবে পড়লেও তা কেটে যাবে।
জুম চাষ যেভাবে হয়
জুম বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে সর্বাধিক প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতি। এর প্রকৃত অর্থ হলো স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে চাষাবাদ করা।এ ধরনের চাষাবাদে শুষ্ক মৌসুমে বনভূমি কেটে বা পুড়িয়ে স্বল্পসময়ের জন্য (এক থেকে তিন বছর) ফসল চাষাবাদের পর প্রাকৃতিক বনভূমির পুনর্জন্ম ও মৃত্তিকার উর্বরতার ক্ষয়পূরণের জন্য দীর্ঘসময় পতিত রাখা হয়।
পৌষ-মাঘ মাসে সুবিধাজনক সময়ে চাষের জন্য এক টুকরো জঙ্গল নির্বাচন করা হয়। জমি নির্বাচনের সময় গাছ, বাঁশ ও আগাছাসহ পাহাড়ের গায়ের ঢালু জায়গাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তারপর সেই জঙ্গলের সমস্ত গাছ, বাঁশ, ঝাড়-জঙ্গল কেটে ফেলা হয়।কাটার পর সেগুলি রোদে শুকানো হয় চৈত্র মাস পর্যন্ত। সাধারণত চৈত্র ও বৈশাখের শুরুতে এতে আগুন জ্বেলে দেওয়া হয়। তাতে শুকিয়ে যাওয়া গাছপালা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সঙ্গে ওপরের ১-২ ইঞ্চি মাটিও পুড়ে যায়। ছাই ও পোড়ামাটির জন্য জমি উর্বর হয়। এরপর দু-এক পশলা বৃষ্টি হলে জমি ভিজে নরম হয়। তারপর বীজ বোনার কাজ শুরু হয়।
চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষের অনুষ্ঠানের পর সাধারণত জমিতে ফসল বোনার উৎসব শুরু হয়। এ সময় পরিবারের সবাই মিলে বীজ বোনার কাজ শুরু করে। সাধারণভাবে জন্মানো প্রধান ফসলের মধ্যে রয়েছে ধান, ভুট্টা, কাউন, তিল, শসা, মিষ্টিকুমড়া, তরমুজ, বরবটি, তুলা, কলা, আদা, হলুদ প্রভৃতি।
থানচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসাইন বেনারকে বলেছেন, স্বাভাবিক চাষাবাদ প্রক্রিয়ায় এবার ব্যতিক্রম হওয়ায় থানচির চারটি ইউনিয়নের জুমচাষিরা মৌসুমি খাদ্য ঘাটতিতে পড়েছে। খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার পরিস্থিতি ইতিমধ্যে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে।তিনি বলেন, দুর্গম এলাকায় খাদ্যশস্য পৌঁছানো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এ জন্য খাদ্যশস্য মজুদ থাকলেও তা পাঠাতে সমস্যা হচ্ছে।