প্রকাশক দীপন হত্যায় পুরস্কার ঘোষিত আসামি মইনুল গ্রেপ্তার
2016.08.24

জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যায় পুরস্কার ঘোষিত আসামি মইনুল হাসান শামীমকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, যাকে ধরিয়ে দিতে দুই লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ওই সন্দেহভাজন জঙ্গি দীপনকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে।
গতকাল বুধবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম। মইনুল হাসান শামীমের সাংগঠনিক নাম শামীম ওরফে সমির ওরফে ইমরান। তার গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার মাধবপুর গ্রামে।
ব্রিফিংয়ে বলা হয়, অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশের জন্য ফয়সাল আরেফিন দীপনকে টার্গেট করা হয়েছিল। মইনুল ওই হত্যা কাণ্ডটি পরিচালনা করে। সে আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার শীর্ষ চার মাসুলের (দায়িত্বপ্রাপ্ত) একজন।
“প্রশিক্ষণ দেওয়া ছাড়াও খুনের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল মইনুল,” ব্রিফিংয়ে জানান মনিরুল ইসলাম।
মনিরুল আরও জানান, খুনের আগে অন্তত এক মাস তাদের প্রশিক্ষণ হয়েছে। ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী চাকরীচ্যুত মেজর জিয়াউল হক দীপনকে খুন করতে উদ্বুদ্ধ করে।
হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীরা প্রথমে টঙ্গী ও পরে মহাখালীতে বাসা ভাড়া নিয়েছিল বলে ব্রিফিংয়ে জানানো হয়।
গত বছরের ৩১ অক্টোবর ঢাকার শাহাবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর অফিসে দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। খুনের পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (আনসার ইসলাম) ওই খুনের দায় স্বীকার করে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (দক্ষিণ) উপকমিশনার মাশরুকুর রহমান বেনারকে বলেন, “গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় মইনুলকে টঙ্গীর চেরাগ আলী মার্কেট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।”
পুলিশ বলছে, সিলেটের মদন মোহন কলেজের ছাত্র মইনুল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, ফয়সাল আরেফিন দীপনকে খুনের ঘটনায় সে ছাড়াও আরও পাঁচজন অংশ নেয়।
এ ছাড়া মইনুল এ বছরের ৪ জানুয়ারি আশুলিয়ায় রিয়াদ মোর্শেদ বাবু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয় বলেও জানায় পুলিশ। রিয়াদ মোরশেদ বাবু গানের শিক্ষক ছিলেন।
মনিরুল ইসলাম বলেন, “মইনুল হাসান ও তার সহযোগীরা একজনকে গান শেখাতে হবে বলে রিয়াদ মোর্শেদকে ডেকে নেয়। তারপর খুন করে।”
যেভাবে চিহ্নিত হয় মইনুল
ফয়সাল আরেফিন দীপন যে দিন খুন হন, একই দিনে ঢাকার লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনের ওপর হামলা চালায় আনসার আল ইসলামের সদস্যরা। ওই ঘটনায় জড়িত একজন আসামি সুমন পাটোয়ারিকে গত ১৫ জুন ঢাকার বিমানবন্দর ওভার ব্রিজ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সুমন ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে দীপন খুনের ঘটনায় মইনুল হাসান শামীমের সম্পৃক্ততার কথা জানায়। এ ছাড়া সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রযুক্তিগত বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখে মইনুল হাসান শামীমের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে পুলিশ নিশ্চিত হয়।
ওই মামলার অন্যতম তদন্ত তদারক কর্মকর্তা রাজীব আল মাসুদ বেনারকে বলেন, “আজিজ সুপার মার্কেটে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাগুলো খুব পরিকল্পিতভাবে বসানো ছিল না। খুনিরা পালানোর সময় ক্যামেরা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। ফুটেজ বিশ্লেষণে বেশ কিছুটা সময় লেগে গেছে।”
এর আগেও গ্রেপ্তার হয়েছিল মইনুল
সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. হারুন অর রশিদ বেনারকে বলেন, “২০১০ সালে নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরিরের প্রচারপত্র বিতরণের সময় ছাতক থানা-পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় মইনুল। সে সময় তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়। ওই মামলায় পুলিশ তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। পরে সে জামিনে বেরিয়ে যায়।”
ছয় ভাই-বোনের মধ্যে শামীম সবার ছোট। সে সিলেটের শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হয়। পরে সিলেটের মদন-মোহন কলেজে ভর্তি হয়।
বুধবার সুনামগঞ্জের ছাতকের মাধবপুর গ্রামের বাসিন্দা ও মইনুলের স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মইনুল কম কথা বলত। মানুষের সঙ্গে মেলামেশাও কম করত। সিলেটে যাওয়ার পর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ কমে যায়।
কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি: দীপনের বাবা
দীপনের খুনি ধরা পড়ার খবর শুনে তাঁর বাবা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, “সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী আন্তরিকভাবে কাজ করেছে। যদিও আসামি পালিয়ে গেছে এমন খবর একবার তাঁদের মুখ থেকে শোনা গিয়েছিল।”
কেমন আছেন—জানতে চাইলে প্রবীণ ওই অধ্যাপক বলেন, “দীপনকে ফিরে পাওয়ার তো কোনো উপায় দেখি না। এই কষ্ট নিয়েই বেঁচে আছি।”
আবুল কাসেম ফজলুল হক আরও বলেন, “দীপনসহ যারা খুন হয়েছে তাঁদের তো কোনো শত্রু ছিল না। তাঁরা কখনো মানুষের মনে কষ্ট দেয়নি। যারা এই খুনগুলো করেছে তারা ‘জল্লাদ’।”
এদিকে দীপনের মৃত্যুর পর থেকে তাঁর সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে ‘রিদমা’ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এখনো সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি।
আনসার আল ইসলাম নিষিদ্ধের প্রস্তাব
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, তাঁরা আনসার আল ইসলাম নিষিদ্ধ করতে সরকারকে চিঠি দেবেন।
পুলিশ জানায়, ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে সংগঠনটি অনলাইনে বিভিন্ন ব্লগের মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহ করত। আয়মান আল জাওয়াহিরি আল কায়েদার দায়িত্ব নেওয়ার পর ভারতীয় উপমহাদেশে আল কায়েদার শাখা (একিউআইএস) হিসেবে আনসার আল ইসলাম আত্মপ্রকাশ করে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
জেএমবির আরও সাতজন গ্রেপ্তার
গত মঙ্গল ও বুধবার রাতে র্যাব ও পুলিশ জেএমবির মোট সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে। জেএমবির নারী শাখার প্রশিক্ষক ও দক্ষিণাঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত আমিরসহ নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনটির পাঁচজনকে আটকের দাবি করেছে র্যাব-১। র্যাব বলছে মঙ্গলবার রাতে ও বুধবার ভোরে গাজীপুরের টঙ্গী ও হাজীর পুকুর এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে ওই পাঁচজনকে আটক করা হয়।
এ ছাড়া পুলিশ টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা এলাকা থেকে জেএমবির কর্মী সন্দেহে দুজনকে গ্রেপ্তার করে। এরা হচ্ছে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার ব্রাম্মবাড়ি গ্রামের জুয়েল মিয়া(২৬) ও বগুড়ার শেরপুর উপজেলার বাগরা কলোনী গ্রামের আবু সাঈদ (২৪)।
র্যাবের হাতে আটককৃতরা হচ্ছে; রাশেদুজ্জামান রোজ, আবদুল হাই, শাহাবুদ্দিন, ফিরোজ আহমেদ ও সাইফুল ইসলাম। তাদের কাছ থেকে পিস্তল, গুলি, হাতবোমা, বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধারের দাবি করেছে র্যাব।
র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খানের ভাষ্য, রাশেদুজ্জামান অনেক দিন কানাডায় ছিলেন। সেখানে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি। ২০১২ সালে দেশে ফিরে তিনি জেএমবিতে যোগ দেন।
আবদুল হাই কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে চট্টগ্রামের একটি মসজিদে ইমাম হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শোলাকিয়ায় হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার সফিউলের সঙ্গে আত্মঘাতী প্রশিক্ষণে অংশ নেন শাহাবুদ্দিন। ফিরোজ ও সাইফুল নানাভাবে জেএমবিকে সহায়তা দিতেন।