বব ডিলানের নোবেল বিজয়ে উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশের মানুষ
2016.10.14

বাংলাদেশের জন্মমুহূর্তে সাড়া জাগানো সংগীত আসরের মধ্যমণি বব ডিলান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশের মানুষ।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে মানুষের সন্তুষ্টি চলছে তাঁকে নিয়ে।
সংগীতের মানুষ সাহিত্যে নোবেল পাওয়া নিয়ে মৃদু প্রশ্ন উঠলেও তা ভেসে যাচ্ছে প্রশংসা আর অভিনন্দনের জোয়ারে।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় আমেরিকান এই সংগীত শিল্পীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। শুক্রবার এক অভিনন্দন বার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বব ডিলানের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন।
১৯৭১ সালের ১ আগস্ট বিকেলে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের মঞ্চে গিটার আর হারমোনিকা হাতে উঠেছিলেন ৩০ বছরের যুবক বব ডিলান।এত লোকের সামনে এর আগে কখনোই তিনি গান করেননি।
কনসার্টের প্রধান আয়োজক ছিলেন জর্জ হ্যারিসন। আগের দিন রিহার্সেলের সময় বব ডিলানের অস্বস্তি দেখে জর্জ হ্যারিসনও চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নার্ভাস যুবক বব ডিলান ৪০ হাজার দর্শকের সামনে একে একে বেশ কয়েকটি গান গেয়েছিলেন।
একাত্তরে বাংলাদেশ জুড়ে পাকিস্তানি সেনা আর আল বদর রাজাকারদের তাণ্ডব শুরু হয়। অসহায় মানুষগুলো পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা পেরিয়ে আশ্রয় নেন ভারতের বিভিন্ন জায়গায়। ওই সংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি।
নিরীহ ও নিরস্ত্র জনগণের ওপর নির্বিচারে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ে দুনিয়াজুড়ে। জীবনবাজী রেখে লড়াই শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধারা। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও তখন পাকিস্তানের পক্ষেই ছিল। কিন্তু সেই সময়ে নারকীয় গণহত্যার বিপক্ষে অবস্থান নেন জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান, পণ্ডিত রবিশঙ্করসহ কয়েকজন।
বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে গানের অস্ত্র নিয়ে মাঠে নামেন তাঁরা। তখন থেকে বব ডিলান হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের রক্তের বন্ধু। প্রায় ৪৫ বছর আগে তিনি বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে গান গেয়েছিলেন। সেই কনসার্টের প্রতিটি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি।
পাকিস্তানি বর্বরতা থেকে মুক্তি প্রত্যাশী বাংলার মানুষদের জন্য কিছু করার তীব্র তাগিদ থেকেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের মানুষের সাহায্যার্থে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে আয়োজিত হয়েছিল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। এলেন গিন্সবার্গ যেমন যশোর রোডে হেঁটেছেন, তেমনই বহু দূরের ম্যাডিসন স্কোয়ারে শব্দযন্ত্র আর কণ্ঠকে হাতিয়ার করে হয়েছিল আরেক মুক্তিযুদ্ধ। সেই যুদ্ধে জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান ও পণ্ডিত রবিশঙ্করসহ অনেকেই সেদিন বাদ্যযন্ত্রকে করেছিলেন হাতিয়ার।
ওই কনসার্ট থেকে প্রায় আড়াই লক্ষ মার্কিন ডলার সংগ্রহ হয়েছিল, যার পুরোটাই ইউনিসেফের তত্ত্বাবধানে ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশীদের সাহায্যার্থে দেওয়া হয়। পরে সিডি ও ডিভিডি বিক্রির অর্থও ইউনিসেফের তহবিলে জমা হয়।
এই অনুষ্ঠানেই বব ডিলান গেয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তির গান। ডিলান একে একে গেয়েছিলেন পাঁচটি গান; ‘আ হার্ড রেইনস আ-গনা ফল’, ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’, ‘ইট টেকস আ লট টু লাফ’, ‘লাভ মাইনাস জিরো’ এবং ‘জাস্ট লাইক আ ‘ওম্যান’। ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’ এর গুঞ্জন প্রতিবাদী করে তুলেছিল সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষকে।
কনসার্টের প্রথমেই পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে অংশ নেন ওস্তাদ আলী আকবর খান এবং আল্লাহ রাখা। রবিশঙ্কর পরে কনসার্টের অভাবনীয় সাফল্য সম্পর্কে বলেছিলেন, “এক দিনের মধ্যে, গোটা বিশ্ব বাংলাদেশের নাম জেনেছিল। এটা ছিল এক অসাধারণ আয়োজন।”
পাকিস্তানিদের হাত থেকে এই ভূখণ্ডের আকাঙ্খার বাস্তবায়নে কনসার্টটির প্রভাব ছিল অপরিসীম। গত ১৩ অক্টোবর তাঁর নোবেল বিজয়ে বাংলাদেশের মানুষ নানাভাবে স্মরণ করেছে ১৯৭১ সালে তাঁর অবদানের কথা।
“আমাদের একটি গর্বিত ইতিহাস রয়েছে, বব ডিলান সেই ইতিহাসের অংশ। মানুষের কল্যাণের জন্যে এগিয়ে আসা এই মহান ব্যক্তিকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাই,” বেনারকে জানান ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তা নুরুল আমিন।
‘ব্লোয়িন ইন দ্য উইন্ড’ আর ‘টাইমস দে আর-আ-চেঞ্জিং’ গান ষাটের দশকে আমেরিকায় সিভিল রাইটস আন্দোলনে জাতীয় সংগীতে পরিণত হয়েছিল। শুরুতে ফোক মিউজিকের ঘরানায় থাকলেও সেই ধারা ভেঙে বেরিয়ে আসেন ডিলান। এরপর কেবলই প্রথা ভেঙেছেন।
পুরস্কারের প্রশংসাপত্রে নোবেল কমিটি বলেছে, ডিলানকে এ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে ‘আমেরিকার মহান সংগীত-ঐতিহ্যে নতুন কাব্যিক অভিব্যক্তি সৃষ্টির জন্য।’
সারা জীবন গান লিখে আর গান গেয়ে গত বৃহস্পতিবার সাহিত্যে নোবেল পেলেন ৭৫ বছর বয়সী মার্কিন গায়ক বব ডিলান।
যে লোককে গোটা বিশ্ব জনপ্রিয় গায়ক হিসেবে চেনে, তাঁর হাতে সাহিত্যে নোবেল তুলে দিলে অনেকেরই যে ভ্রু কুঁচকে যাবে, সেটা পুরস্কারের আয়োজকেরা আগাম অনুমান করেছেন।
সে জন্য গত শুক্রবার স্টকহোমে পুরস্কার ঘোষণার সময় সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সচিব সারা ড্যানিয়ুস বলেন, তিনি আশা করছেন, এই সিদ্ধান্তের জন্য একাডেমিকে সমালোচনা করা হবে না।
ড্যানিয়ুস আরও বলেন, “ডিলানকে বেছে নেওয়া বিস্ময়কর মনে হতে পারে বটে, তবে তাঁকে পড়াও যায় এবং পড়াই উচিত। ইংলিশ ঐতিহ্যমাফিক তিনি এক মহান কবি।”
নোবেল কমিটির এই ঘোষণায় কিছুটা স্বীকারোক্তিমূলক সুর ধ্বনিত হলেও নোবেল পুরস্কারের জন্য ডিলানের নাম অন্তত ২০ বছর ধরে শোনা যাচ্ছিল। তাঁর গানের কথা যে উৎকৃষ্ট কবিতা, এটা এমনকি অনেক প্রথিতযশা কবিও স্বীকার করছিলেন।
“সুইডিশ একাডেমি বব ডিলানকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দিয়ে সঠিক কাজ করেছে। বাংলাদেশও তাঁর এই গর্বের অংশীদার, কারণ এই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান রয়েছে,” বেনারকে জানান ঢাকার ব্যবসায়ী এ কে চৌধুরী, যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা।