সার কারখানা থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস ছড়িয়ে পড়ায় অর্ধশতাধিক মানুষ হাসপাতালে
2016.08.23

বাংলাদেশের চট্টগ্রামে একটি সার কারখানায় অ্যামোনিয়াম ফসফেটের বার্নাল (আধার) বিস্ফোরণ ঘটেছে, যাতে প্রায় ২৫০ টন অ্যামোনিয়া মজুদ ছিল। ছড়িয়ে পড়া এ গ্যাসের তীব্রতায় অর্ধশতাধিক মানুষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, সাময়িক অসুস্থ হন আরও দুই শতাধিক মানুষ।
তাৎক্ষণিকভাবে বিস্ফোরণের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, অ্যামোনিয়া গ্যাসের প্রভাবে সাময়িক শ্বাসকষ্টের শিকার হয় মানুষ ও প্রাণীকুল। তবে এই গ্যাস পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
হাসপাতালে ভর্তি ৫৬ জন
সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর আনোয়ারায় পতেঙ্গার ১৫ নম্বর ঘাট এলাকার উল্টো দিকে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব পাড়ে ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট ফার্টিলাইজার (ডিএপি) কোম্পানি লিমিটেডের কারখানায় দুর্ঘটনাটি ঘটে। মুহূর্তের মধ্যেই নদীর পশ্চিম পাড়ে চট্টগ্রাম নগরের বন্দর ও হালিশহর এলাকায় অ্যামোনিয়া গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে।
এ ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন স্থানীয়রা। গ্যাসের তীব্রতায় অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রায় অর্ধশত মানুষ।
প্রায় ৫০০ টন ধারণক্ষমতার ট্যাংকটিতে দুর্ঘটনার সময় মজুদ ছিল প্রায় ২৫০ টন অ্যামোনিয়া গ্যাস। নগরীর আগ্রাবাদ, হালিশহর, বন্দর, পতেঙ্গা, বারিক বিল্ডিং, ইপিজেডসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায়। তবে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গন্ধের তীব্রতা কমে যায়।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকি সাংবাদিকদের জানান, গ্যাসের কারণে শ্বাসকষ্টের শিকার ৫৬ জনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। তবে এখন তারা সম্পূর্ণভাবে আশঙ্কামুক্ত। এদের বেশিরভাগই চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
পতেঙ্গার বাসিন্দা রুবেল হাসান বেনারকে বলেন, “রাতে বিকট শব্দ শুনতে পাই। এরপর গ্যাসের উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। ঘরের দরজা বন্ধ রেখেও রেহাই পাচ্ছিলাম না। পরে শ্বাসকষ্ট ও কাশি হয়, চোখ জ্বালাপোড়া করতে থাকে।”
এদিকে ঘটনাস্থলের চারপাশে বেশ কয়েকটি এলাকায় পুকুরে মাছ মরে ভেসে উঠতে দেখা যায়। এ ছাড়া আশপাশের গাছের পাতা লাল রং ধারণ করেছে বলে বেনারকে জানান চট্টগ্রামের সাংবাদিক রমেন দাশ গুপ্ত।
দুইটি পৃথক কমিটি গঠন
সংশ্লিষ্টরা জানান, অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঘনত্ব পানির কাছে আসলে কমে যায়। এর কারণে দুর্ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিসের একাধিক ইউনিট কৃত্রিম বৃষ্টির মাধ্যমে গ্যাস দূর করতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক জসীম উদ্দিন।
ঘটনার কারণ তদন্তে জেলা প্রশাসন ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন বেনারকে বলেন, “দুর্ঘটনার কারণ জানতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে কমিটি কাজও শুরু করেছে।”পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সকল ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
ট্যাংক ফেটে গ্যাস বিস্ফোরণের কারণ, ক্ষয়ক্ষতি ও দায়দায়িত্ব নির্ধারণে বিসিআইসি পক্ষ থেকেও ১০ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটির প্রধান করা হয়েছে বিসিআইসির পরিচালক আলী আক্কাসকে। কমিটিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, জেলা প্রশাসন এবং দুটি সার কারখানা কাফকো ও সিইউএফএলের প্রতিনিধিও রয়েছেন।
এ বিষয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বিসিআইসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, “আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন দেবে ১০ সদস্যের কমিটি। একইসঙ্গে কারখানার বাকি ট্যাংকগুলোর পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা এড়াতে করণীয় সুপারিশ করবে এ কমিটি।”
ক্ষতি দীর্ঘমেয়াদি নয়
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইউরিয়া সার তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান অ্যামোনিয়া গ্যাস তাৎক্ষণিকভাবে বাতাসের সঙ্গে মিশে ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয়। যা সাময়িকভাবে মানুষসহ প্রাণীকুলের শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে দেয়। তবে পরিবেশে এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী নয়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আফতাব আলী শেখ বেনারকে বলেন, “অ্যামোনিয়াম ফসফেট বাতাসের সঙ্গে মিশে অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি করে। যা ফুসফুসে ঢুকে শ্বাসকষ্ট তৈরি করে। এতে অনেক সময় মানুষ বা প্রাণী শ্বাসরোধ হয়ে মারাও যেতে পারে।”
তবে এই গ্যাসে মানুষের পাশাপাশি মাছ, পোকামাকড়, গরু ছাগল প্রভৃতি প্রাণী মারা গিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলেও এর স্থায়িত্ব বেশিদিন থাকবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।
এর কারণ হিসেবে এই রসায়নবিদ বলেন, “গ্যাসটি ধীরে ধীরে বাতাসে মিশে যাবে। ফলে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকে না।”