গার্লস অপরচুনিটি সূচকে বাল্যবিবাহ বাংলাদেশের মেয়েদের পিছিয়ে রেখেছে
2016.10.13
সেভ দা চিলড্রেনের গার্লস অপরচুনিটি ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান এবার ১৪৪টি দেশের মধ্যে ১১১তম। শিশু সুরক্ষায় বিশ্বব্যাপী নিয়োজিত এই উন্নয়ন সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশের মেয়েদের পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ।
বাল্যবিবাহের হারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। সরকারি হিসাবে দেশের ৬৪ শতাংশ শিশুর বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে।
মঙ্গলবার রাতে গার্লস অপরচুনিটি সূচক প্রকাশ করে সেভ দা চিলড্রেন। এতে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র আফগানিস্তানের অবস্থান বাংলাদেশের নিচে।
বাল্যবিবাহের হার, কিশোরী মাতৃত্ব, মাতৃমৃত্যু, পুরুষের তুলনায় সংসদে নারী সাংসদদের সংখ্যা এবং স্কুল শেষ করার হারের ভিত্তিতে এই ইনডেক্সটি নির্ধারণ করা হয়। সেভ দা চিলড্রেনের এই মূল্যায়ন সম্পর্কে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এখনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেননি। তবে তাঁরা স্বীকার করেছেন বাংলাদেশে বাল্য বিবাহের হার এখনো অস্বাভাবিক।
গার্ল সামিট ও অঙ্গীকার
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি বন্ধ করার অঙ্গীকার করেন।
প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাজ্য থেকে ফিরে আসার পর ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ আইনটি সংশোধনের কাজ শুরু হয়। তবে দুই বছরেও এটি চূড়ান্ত করতে পারেনি সরকার।
সরকারের বিভিন্ন সূত্র জানায়, বিয়ের বয়স ক্ষেত্রবিশেষ ১৮ থেকে ১৬ বছরে নামিয়ে আনার প্রস্তাব নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। তাই আইনটি এখনও হিমাগারে রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বেনারকে বলেন, “এখন যে আইনটি আছে সেখানে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ এবং ছেলেদের বিয়ের বয়স ২১ আছে। তারপরও বাল্যবিয়ে হচ্ছে। নতুন যে আইনটি হচ্ছে সেটি অনেক বেশি শক্তিশালী হবে। আশা করছি দ্রুতই আইনটি পাশ হবে।”
বাল্যবিয়ে বন্ধের দাবিতে গাইবান্ধায় মানববন্ধন। স্টার মেইল। অক্টোবর ০৫, ২০১৬।
তবে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, আইনটি আসলে ১৮ আর ১৬ বছরের বিতর্কে আটকে আছে। বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘কুমারীত্ব’ একটি বড় বিষয়। দেশে যত নারী ধর্ষণের শিকার হয় তার দুই-তৃতীয়াংশ কিশোরী। ধর্ষণজনিত কারণে কেউ গর্ভধারণ করলে বা কৈশোরে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলে বা মেলামেশার কারণে গর্ভধারণ করলে শিশুটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। সেই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ১৬ বছরে বিয়ের একটি সুযোগ রাখা হয়েছে।
গার্লস অপরচুনিটি ইনডেক্স যা বলছে
এই ইনডেক্সে বিশ্বব্যাপী বাল্যবিবাহকে মেয়েদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকারক বলে মন্তব্য করা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রতি সাত সেকেন্ডে বিশ্বের কোথাও না কোথাও একটি মেয়ে শিশুর বিয়ে হচ্ছে।
ইনডেক্সের শীর্ষে থাকা দেশগুলো হলো সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, স্লোভেনিয়া, পর্তুগাল, সুইজারল্যান্ড ও ইতালি।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মালদ্বীপ সবচেয়ে এগিয়ে আছে। দেশটির অবস্থান ৫০, এরপর শ্রীলঙ্কা (৬০), ভুটান (৮০), নেপাল (৮৫), পাকিস্তান (৮৮), ভারত (৯০), বাংলাদেশ (১১১) এবং আফগানিস্তান (১২১)।
পাঁচটি নির্ণায়কের মধ্যে একমাত্র মাতৃ মৃত্যু ছাড়া বাকি চারটি নির্ণায়কেই বাংলাদেশের অবস্থান খুবই নাজুক। সেভ দা চিলড্রেন তালিকার ১১১ থেকে ১৪৪ নম্বরে অবস্থানকারী দেশগুলো সম্পর্কে বলছে, বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোয় মেয়েদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এসব দেশে মেয়েরা মারাত্মক বঞ্চনার শিকার। দেশগুলোর উচিত হবে দ্রুত মেয়ে শিশু বান্ধব নীতি গ্রহণ করা ও মাঠে তার বাস্তবায়ন ঘটানো।
সেভ দা চিলড্রেনের সিইও ক্যারোলিন মাইলস নিউজউইককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “বাংলাদেশে প্রতি তিনটি মেয়ের একটির ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। বাল্যবিয়ে একটি দুষ্ট চক্রের সূচনা করে। এতে করে মেয়েটি দক্ষতা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, জীবনে উন্নতি করতে পারে না এবং শৈশবকে উপভোগ করতে পারে না।”
বাল্যবিয়ের জন্য দায়ী কে?
মেয়ে শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারা, বয়স বেশি হলে যৌতুকের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা, দারিদ্র্য ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার বেশি।
বাল্যবিবাহ রোধ নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের পর্যবেক্ষণ হলো, যেসব এলাকায় জন্মনিবন্ধনের হার কম, সেখানে বাল্যবিবাহের হার বেশি।
বাল্যবিবাহ রোধ প্রসঙ্গে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রাজীব সরকার বেনারকে বলেন, “এলাকার জনপ্রতিনিধি, মহিলা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, প্রভাবশালী লোকজনসহ সবার সহযোগিতা ছাড়া বাল্য বিয়ে বন্ধ করা সম্ভব নয়।”
ওই কর্মকর্তা জানান, জন্মনিবন্ধন ঠিকমতো না হওয়ায় বয়স বাড়িয়ে বিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে।
এ বছরের জানুয়ারিতে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলাকে বাল্যবিবাহ মুক্ত উপজেলা ঘোষণা করা হয় এবং সারা দেশে ওই উপজেলার আদলে বাল্যবিবাহ নিরোধের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রতি শুক্রবার প্রশাসন ঈশ্বরগঞ্জের বিভিন্ন বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতো। তবে প্রায়ই দেখা যেত বিয়ে বন্ধ করার পর ছেলে–মেয়েদের পাশের উপজেলায় নিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
রাজীব সরকার বলেন, এক মাস জেল ও এক হাজার টাকা জরিমানা এমন অপরাধের জন্য খুবই লঘু বলে মনে হয়। এটা বন্ধে কঠোর শাস্তির সুপারিশ করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সম্মিলিত ম্যারেজ রেজিস্ট্রার ফোরামের সভাপতি কাজী সাব্বির বেনারকে বলেন, “সব কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকলে বিয়ে না পড়িয়ে উপায় থাকে না। বাল্যবিবাহ রোধ করতে হলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভুয়া জন্মসনদ দেওয়া বন্ধ করতে হবে।”