আইএস আছে-আইএস নেই বিতর্কের মধ্যেই দেড় বছরে ৬২ হামলায় নিহত ৭৮

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.07.03
160703-BD-floral-1000.jpg গুলশান ৭৯ নম্বর সড়কের প্রবেশ মুখে পুলিশের ব্যারিকেড ঘেঁষে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের স্মরণে ফুলের তোড়া রেখে যাচ্ছেন স্বজনেরা। জুলাই ০৩, ২০১৬।
এএফপি

গত প্রায় দেড় বছরে ৬২টি জঙ্গি হামলায় ৭৮ জন নিহত হয়েছেন। এসব হামলার অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই ২৭টিতে আইএস (ইসলামিক স্টেট) ও ৭টিতে একিউআইএস (আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা) দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে।

সরকার বলে আসছে, এ দেশে আইএস বা আল-কায়েদার কোনো অস্তিত্ব নেই, এসব দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। আইএস আছে, আইএস নেই—এই বিতর্কের মধ্যেই জঙ্গিরা গত শুক্রবার গুলশানের কূটনৈতিক এলাকার এক স্প্যানিশ রেস্তোরাঁয় আক্রমণ ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জানান দিয়েছে।

গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশানে ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলাকে হত্যার মধ্য দিয়ে এ দেশে আইএসের দায় স্বীকারের পর্ব শুরু হয়। এরপর একই কায়দায় ধারাবাহিক হামলা, হত্যা চলে আসছে। গত ১০ মাসে এমন ২৭টি হামলার দায় স্বীকার করে আইএস তাদের কথিত বার্তা সংস্থা আমাক নিউজে বিবৃতি দিয়েছে।

গত শুক্রবারের আক্রমণ সরকারের জঙ্গি দমনের সাফল্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। মাত্র পাঁচ-ছয়জন তরুণ ক্ষুদ্রাস্ত্র, বোমা ও ছোরা নিয়ে রাজধানীর সুরক্ষিত বলয়ে ঢুকে যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তাতে পুরো দেশবাসী স্তম্ভিত। তাদের সামাল দিতে সেনা নেতৃত্বে সম্মিলিত অভিযান চালাতে হয়েছে।

ওই হামলা যে গত এক বছরে তাদের অন্যান্য হামলার ধারবাহিতা, সেটাও আইএস সর্বশেষ বার্তায় বুঝিয়ে দিয়েছে। তারা গুলশান হত্যাযজ্ঞে তাদের তোলা ছবি দিয়ে একটি পোস্টার তৈরি করেছে। তাতে তাদের পরবর্তী টার্গেটদের উদ্দেশ্য করে বলেছে, “ও ক্রুসেডার তুমি, তোমার পরিবার ও বন্ধু সবাই আমাদের টার্গেট। আমরা তোমাদের হত্যা করব, এমনকি তোমাদের স্বপ্নকেও।”

শুক্রবার রাত পৌনে নয়টায় ওই জঙ্গি হামলার পর থেকে আইএসের কথিত বার্তা সংস্থা আমাক নিউজ দফায় দফায় ভেতরের খবর দিয়ে আসছিল। বাংলাদেশ সময় শুক্রবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে আমাক নিউজ তাদের চতুর্থ বার্তায় জানায় যে গুলশানের রেস্তোরাঁর ভেতরে থাকা আইএসের জঙ্গিরা ২৪ জনকে হত্যা করেছে। অবশ্য পরে হিসাব মিলেছে, দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জনের।

ওই রাতে রেস্তোরাঁর ভেতর জঙ্গিদের হাতে নিহত ২০ জনের মধ্যে দুজন বাংলাদেশি ও একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। বাকি ১৭ জনই বিদেশি নাগরিক। এদের মধ্যে নয়জন ইতালির, সাতজন জাপানের ও একজন ভারতের নাগরিক।

শনিবার ভোর সাড়ে ছয়টায় আমাক নিউজ রেস্তোরাঁর ভেতর জবাই করার বেশ কজন জিম্মির ছবি প্রকাশ করে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে জঙ্গিরা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নিয়মিত বাহিরে যোগাযোগ রেখেছিল।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিহত জঙ্গিদের ছবি গণমাধ্যমে পাঠানোর আগেই আইএস হামলায় অংশ নেওয়া পাঁচ জঙ্গির ছবি প্রকাশ করে।

জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা যাঁরা পর্যবেক্ষণ করেন, তাঁদের মতে, সরকারের অস্বীকার বা উপেক্ষার সুযোগে গত এক-দেড় বছরে আইএস মতাদর্শের জঙ্গিরা অনেক দূর শিকড় গেড়েছে।

এদিকে গতকাল পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক গণমাধ্যমকে বলেছেন, গুলশানের ঘটনা জেএমবি ঘটিয়েছে। এদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ থাকলেও থাকতে পারে। আইজিপি জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দেশের জনগণ এবং গণমাধ্যমের সমর্থন ও সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেছেন।

“আইএস আছে কি নেই, তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে একের পর এক ঘটনা তো ঘটছে। এ দেশে আইএস না থাকলেও তাদের ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ অনুসারিরা সক্রিয়,” বেনারকে জানান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।

দেশে আইএস বিতর্ক যেমন চলছে, তেমনি জঙ্গিবাদ ঠেকাতে চলছে নানা প্রস্তুতি। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করতে ও পরিকল্পিত হত্যা ঠেকাতে পারবে কিনা, সেই প্রশ্ন দিন দিন বড় হয়ে উঠেছে।

ইতিমধ্যে আগামী ১২ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত দেশের সব ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলায় কবি-সাহিত্যিক–সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করতে ১৪ দল সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছে।

নিন্দা ক্ষোভ

গুলশানের হলি আর্টিজানের জঙ্গি হামলার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ক্ষোভ ও নিন্দা অব্যাহত রয়েছে। সেই সঙ্গে তাঁরা তাদের প্রতিক্রিয়া ও বিবৃতিতে সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশের পাশে থাকার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

গুলশানের জঙ্গি হামলার পর গুলশান-বারিধারার নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদু। তিনি গতকাল সকালে তাঁর দপ্তরে গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও জোরদারের বিষয়ে দুয়েকদিনের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে তাঁর দপ্তরে আলোচনার সময় ইউরোপীয় জোটটির রাষ্ট্রদূত আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, গত বছর দুই বিদেশি হত্যার পর বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা যেভাবে বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছেন, এবারও তেমনটা ঘটতে পারে।

এদিকে জাপানের সাত নাগরিক হত্যার তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছে টোকিও। বাংলাদেশ সফররত দেশটির পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সেইজি কিহারা গতকাল রোববার একাধিক বৈঠকে বিয়োগান্ত ওই ঘটনার নেপথ্যে কি ছিল সে সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। নিহত নাগরিকের মৃতদেহ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নিতে সোমবার জাপানের একটি বিশেষ বিমান ঢাকায় আসছে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সেইজি কিহারা ঢাকায় পৌঁছে সকালে গুলশানের হামলার স্থল ঘুরে দেখেছেন। এ ছাড়া তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এসব বৈঠকে গুলশানের হামলার পর পরিস্থিতির ব্যাপারে জাপান সরকারের মনোভাব তুলে ধরেন তিনি।

সরেজমিন হলি আর্টিজান

গতকাল রোববার রাজধানীর গুলশান এলাকার ৭৯ নম্বর সড়কের প্রবেশমুখে ছিল পুলিশের ব্যারিকেড। বামপাশে ব্যারিকেড ঘেঁষে ছিল ফুলের তোড়া। শনিবার এই সড়কের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় নিহতদের স্মরণে এই তোড়াগুলো রেখে গেছেন তাঁদের বন্ধু, স্বজন ও সাধারণ মানুষ। তাঁরা সবাই ছিলেন শোকাহত, স্তম্ভিত।

গুলশানের রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের স্মরণে সরকার ঘোষিত দুই দিনের জাতীয় শোক দিবসে কালো ব্যাজ পরে জাপান দূতাবাসের এক দোভাষী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করছেন। জুলাই ০৩, ২০১৬। ফটোঃএএফপি।

“আমরা ভীষণভাবে শোকাহত। যারা এখানে নিহত হয়েছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। আমরা এমন দেশ চাই, যেখানে সব ধরনের মানুষ মিলেমিশে বসবাস করবে,” বেনারকে জানান চিত্রশিল্পী মনিরুজ্জামান।

হাসপাতালে ৩২ জন

গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় আহতদের ৩২ জন বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তাঁদের  মধ্যে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পুলিশসদস্য দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁরা  হলেন—পুলিশ কনস্টেবল সুকুমার কুমার কুণ্ড ও হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি জাকির হোসেন।

গুলশানের রেস্তোরাঁয় হামলাকারী জঙ্গিদের মৃতদেহগুলি ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে নেয়ার পূর্বে ব্যাগে ভরে রাখা অবস্থায়। জুলাই ০২, ২০১৬। ফটোঃ এএফপি।

মরদেহ হস্তান্তর

নিহতদের লাশ আজ সোমবার সকাল ১০টায় আর্মি স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করবেন। মৃতদেহ ময়নাতদন্তের পর গতকালই হস্তান্তর করা হবে এই আশায় স্বজনরা সকাল থেকেই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) অপেক্ষা করতে শুরু করেন। পরে সিএমএইচ থেকে তাঁদের আজ সকাল ১০টায় আর্মি স্টেডিয়ামে আসতে অনুরোধ জানানো হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।