ডায়াবেটিস ভারতকে বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন করছে

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2016.04.15
160415-IN-diabetes-620.jpg বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে ভারতের হায়দ্রাবাদে একটি বিনামূল্যে ডায়াবেটিস নিরীক্ষা শিবিরে একজন সেবিকা এক পুলিশ সদস্যের রক্ত পরিক্ষার করছেন। এপ্রিল০৭,২০১৬
এএফপি

দু’বেলা ইনসুলিনের সুঁই বাঁচিয়ে রেখেছে স্বপ্না সেনগুপ্তকে। কলকাতার দমদম অঞ্চলের বাসিন্দা, বছর সত্তরের এই প্রাক্তন স্কুলশিক্ষিকা পনের বছরেরও বেশি ভুগছেন টাইপ টু ডায়াবেটিসে। কীভাবে এই রোগ বাসা বাঁধল তাঁর শরীরে, ডাক্তাররা বলতে পারেননি।

ডায়াবেটিস কেন হয়, তা এখন চিকিৎসা শাস্ত্রের অজানা। কিন্তু কীভাবে এই রোগ বদলে দিতে পারে এক জন মানুষের জীবন, তা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন। নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বলছিলেন স্বপ্না সেনগুপ্ত।

“এই রোগে যদিও রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়, কিন্তু এই রোগে আক্রান্তদের বড় ঝুঁকি হলো যে কোনো সময় রক্তে শর্করা কমে যাওয়া। তা থেকে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তো আছেই, বাড়াবাড়ি হলে কোমায় চলে যাওয়াটাও অসম্ভব নয়,” জানালেন স্বপ্না।

তাঁর মতে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার অর্থ, একরাশ বিপদের মাঝখানে বসে থাকা। পাশাপাশি রয়েছে চোখ, কিডনি খারাপ হওয়ার ঝুঁকি, ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির সম্ভাবনা।

ভারতের সাড়ে ছয় কোটি মানুষ এখন এসব ঝুঁকি নিয়েই বাঁচছেন। হ্যাঁ, বিশ্বের অন্যতম চিকিৎ​সা সাময়িকী ল্যানসেটের সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, এই মুহূর্তে ভারতে ছয় কোটি পঁয়তাল্লিশ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ১৯৮০ সালে সংখ্যাটি ছিল এক কোটি উনিশ লাখ।

গোটা দুনিয়ায় এখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মোট ৪২ কোটিরও বেশি মানুষ, যাঁদের সিংহভাগই থাকেন ভারত, চীন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। অর্থাৎ, ভারত এখন গোটা দুনিয়ার ডায়াবেটিস রাজধানী হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি প্রতিবেদন বলছে, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ আর ক্যানসার ভারতকে বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন করছে। এই রোগগুলোকে আক্রান্ত মানুষের উৎপাদনশীলতা নষ্ট করছে। তা ছাড়া এসবের চিকিৎসার খরচ বাবদ ২০১২ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতে মোট ছয় লাখ কোটি ডলারেরও বেশি খরচ হবে।

অস্বাস্থ্যকর জীবনশৈলী

কলকাতার এএমআরআই হাসপাতালের এন্ড্রোক্রিনোলজির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পার্থসারথি মণ্ডল বেনারকে জানান, “কেন ডায়াবেটিস হয়, চিকিৎসা শাস্ত্র তা এখনও সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি। তবে, মানুষের জীবনশৈলী যে এই রোগের একটা বড় কারণ, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কম শারীরিক পরিশ্রম, বেশি জাঙ্ক ফুড খাওয়া, সুষম আহারের অভাব, ব্যায়াম না করা, এক জায়গায় দীর্ঘ ক্ষণ বসে থাকার ফলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অতি দ্রুত বাড়ছে।”

একটি মোবাইল অ্যাপের সমীক্ষায়ও উঠে এল সে কথা। কিয়োরিফাই নামক অ্যাপটি ভারতের ১৬১৭ জন চিকিৎসকের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালিয়ে ডায়াবেটিস সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নে তাঁদের মতামত জানতে চায়। ৬০ শতাংশ চিকিৎসক বলেছেন, সমস্যাটি মূলত জীবনশৈলীরই।

ম্যাক্স হেলথ কেয়ারের ডায়াবেটিস অ্যান্ড ওবেসিটি বিভাগের ডিরেক্টর সুজিত ঝাঁ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানান, “যে কোনো বাজারচলতি খাবারেই বাড়তি শর্করা আর লবণ যোগ করা হয়। ডায়াবেটিস এড়াতে এই খাবারগুলো বাদ দিন। সুস্থ থাকার জন্য যত বেশি সম্ভব টাটকা শাকসবজি খাওয়া, ফল খাওয়া এবং সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট হাঁটা প্রয়োজন।”

চিকিৎসক সমাজের একটি বড় অংশ দাবি তুলেছেন, তামাকজাত পণ্য বা মদের ওপর যেমন বিপুল শুল্ক আরোপ করা হয়, তেমনই অতিরিক্ত শর্করাযুক্ত পানীয় ও জাঙ্ক ফুডের ওপর ধার্য করা হোক চড়া শুল্ক, যাতে এই পণ্যগুলোর বিক্রি কমে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রে জানা গেল, সরকার এই প্রস্তাবটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে।

বিশ্বায়নের প্রভাব

ল্যানসেটের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ধনী দেশগুলিতে ডায়াবেটিসের প্রকোপ যে হারে বেড়েছে, দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বেড়েছে তার চেয়ে ঢের বেশি হারে। এ ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আর ডায়াবেটিসের প্রকোপের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে।

দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির গবেষক পৃথা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “এই সম্পর্কটি যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ। আর্থিক উদারনীতির ফলে ভারত বা চিনের মতো দেশে সাধারণ মানুষের আয় গত দুই দশকে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বেড়েছে। অন্য দিকে, বিশ্বায়নের ফলে প্রচুর জাঙ্ক ফুড পৌঁছেছে তাঁদের হাতের নাগালে। সেই খাবারগুলো ভয়ানক অস্বাস্থ্যকর ঠিকই, কিন্তু যাঁদের ক্রয়ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে, মানুষ এই খাবারগুলো খাচ্ছেন বেশি পরিমাণে।

“ভারতে মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলে গেছে। প্রাকৃতিক খাদ্য, সুষম খাদ্য অনেক কম খাচ্ছেন মানুষ। অন্য দিকে, আধুনিক নগরজীবনে মানসিক চাপ বেড়েছে বহু গুণ। সেই মানসিক চাপও আমাদের ঠেলে দিচ্ছে ডায়াবেটিসের দিকে,” বেনারকে জানান কলকাতার ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পার্থ রায়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।