কোটি টাকার জাল নোটসহ সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা গ্রেপ্তার

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.09.08
20160908-Fake-Money1000.jpg ঢাকার জুরাইন ও বনশ্রী এলাকা থেকে এক কোটি টাকার জালনোটসহ পাঁচজনকে আটক করে র‌্যাব। সেপ্টেম্বর ৮, ২০১৬।
নিউজরুম ফটো

ঈদের বাজার যত সরগরম হচ্ছে ততই সক্রিয় হয়ে উঠেছে নোট জালিয়াতি চক্র। গতকাল বৃহস্পতিবার এক কোটি টাকার জাল নোটসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব, যাদের একজন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা।

জাল নোট কারবারি চক্রের সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তার যোগ-সাজশ ভাবিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। যদিও দুর্নীতির দায়ে আগেই চাকরি হারিয়েছিলেন আব্দুর রশিদ (৬৫) নামের ওই ব্যক্তি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকেও এ বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে।

র‌্যাব সদরদপ্তরের পরিচালক (আইন ও গণমাধ্যম শাখা) মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিকদের জানান, গত বুধবার রাতে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়।

আবদুর রশিদ ছাড়া আটকৃতরা হলেন; ফাতেমা বেগম (২৫), রুবিনা বেগম (২৪), মো. দুলাল (৩০) ও মো. সারোয়ার হোসেন (২৩)।

এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানানো হয়।এ সময় র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ জানান, বুধবার রাতে রামপুরার বনশ্রীর একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে রুবিনা বেগম ও ফাতেমা বেগমকে আটক করা হয়। এ সময় ওই বাসা থেকে ৭৮ লাখ টাকার জাল নোট, একটি ল্যাপটপ ও জাল নোট তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাব জানায়, রুবিনা ও ফাতেমার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পরে আবদুর রশিদ, মো. দুলাল হোসেন ও মো. সারোয়ার হোসেনকে আটক করতে সক্ষম হয় র‌্যাব সদস্যরা। এ সময়ে সারোয়ারের কাছ থেকে দুই লাখ টাকার জাল নোট এবং আবদুর রশিদ ও দুলালের বাসা থেকে আরো ২৩ লাখ টাকার জাল নোট ও নোট তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।

এর আগে গত ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫২ লাখ টাকার জাল নোটসহ জালিয়াতি চক্রের আট সদস‌্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আরও দুটি চক্র নোট জালিয়াতি করছে বলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে বলে সেসময় জানিয়েছিল পুলিশ।

চাকরি হারিয়ে জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত

র‌্যাব কর্মকর্তা তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ জানান, এক সময়ে অগ্রণী ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার হিসেবে কাজ করলেও ১৯৯৫-৯৬ সালের দিকে দুর্নীতির দায়ে চাকরি হারান আবদুর রশিদ। এরপর দুই বছর জেলে ছিলেন তিনি।

কারাগারেই পরিচয় হয় ভারতীয় জাল মুদ্রা তৈরির অভিযোগে গ্রেপ্তার নুরুজ্জামানের সঙ্গে। জেল থেকে বের হয়ে প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসা শুরু করেন রশিদ। আবারও নুরুজ্জামানের সঙ্গে দেখা হয় তার। এরপর থেকে যৌথভাবে তারা ভারতীয় জাল টাকা তৈরি শুরু করেন।

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব জানায়, শুরুর দিকে ভারতীয় জাল মুদ্রা তৈরিতে নিরাপত্তার ছাপ দেওয়ার কাজ করলেও পরে বাংলাদেশি টাকায় নিরাপত্তা ছাপ দেওয়া শুরু করেন রশিদ। এক সময়ে তার প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর জাল টাকার বড় চক্রের সঙ্গে এ কারবার শুরু করেন। র‌্যাবের দেওয়া তথ্যমতে, গত দেড় দশক ধরে সাবেক এই ব্যাংক কর্মকর্তা জাল নোট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এই দীর্ঘ সময়ে মাত্র একবার গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বেরিয়ে একই কাজে জড়িয়েছেন তিনি।

আটকৃতদের সঙ্গে উদ্ধার হওয়া জাল নোট ও নোট তৈরির সরঞ্জাম। সেপ্টেম্বর ৮, ২০১৬। নিউজরুম ফটো।

আসল নোটের মতই জাল নোট

র‌্যাবের তথ্যমতে, নুরুজ্জামানের মাধ্যমে ভারত থেকে জাল টাকার কাগজ ও মিহি নিরাপত্তা সুতা আমদানি করা হয়। এরপর জলছাপ দিতেন রহিম। আর এসব জাল নোট দেখতে আসল নোটের মতোই।

এ বিষয়ে র‌্যাব কর্মকর্তা মাসুদ জানান, এসব জাল নোটের নিরাপত্তা সূতা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ছাপাসহ অমসৃন রেখাগুলো অত্যন্ত নিখুঁতভাবে করা হয়েছে। যা সাধারন মানুষের পক্ষে ধরা প্রায় অসম্ভব।

তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ জানান, ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে এই চক্রটি প্রায় কোটি টাকার জাল নোট বাজারে সরবরাহ করেছিল। তারা বাজারে ছাড়তে আরো দুই কোটি টাকা প্রস্তুত করছিল। নির্দিষ্ট সিণ্ডিকেটের মাধ্যমে এরা এসব জাল নোট বাজারে ছাড়ে।

ক্ষতির সম্মুখীন হয় সাধারণ মানুষ

বিশ্লেষকরা বলছেন, জাল টাকা বাজারে ঢুকে অর্থনীতির যে ক্ষতি সাধন করে তাতে প্রধান শিকার হয় সাধারণ মানুষ। জাল টাকা রোধে সরকারকে আরো কঠোর হওয়ার পরামর্শ তাঁদের।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “জাল টাকা অর্থনীতির জন্য অনাকাঙ্খিত ব্যাপার। এর ফলে সাধারণ, নিষ্পাপ লোকজন ভোগান্তিতে পড়ে।”

তিনি বলেন, “এদের শেকড় কোথায় সেটা খুঁজে বের করা দরকার। আইনশৃ্খলা বাহিনী এবং বাংলাদেশ ব্যাংক মিলে জাল টাকা ঠেকাতে আরও কঠোর হতে হবে”।

ব্যাংকগুলোর মাধ্যমেও জাল টাকা ছড়ায় উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “বিভিন্ন ব্যাংকের থেকে টাকা তোলার পর সেই টাকাতেও জাল নোট পাওয়া যায়। তাই ব্যাংকগুলোকে সতর্ক হতে হবে যাতে তাদের মাধ্যমে জাল টাকা না আসে।”

এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতি বছরই ঈদ কেন্দ্রিক কেনাকাটার মৌসুমে নোট জালিয়াত চক্রের তৎপরতা বেড়ে যায়। এবারের কোরবানির ঈদ সামনে রেখে এ বিষয়ে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।

“পশুর হাটগুলোতে বিপুল অংকের টাকা লেনদেনের সুযোগে কেউ যাতে জাল নোট ছড়াতে না পারে সেজন্য হাটে জালনোট শনাক্তকারী মেশিন বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে,” বেনারকে জানান র‍্যাবের একজন কর্মকর্তা।

ঈদ সামনে থাকায় জাল নোট নিয়ে ভীত ও বিব্রত ক্রেতা–বিক্রেতাদের অনেকেই।

হতিরপুলের মুদি দোকানদার আবদুল মাসুম বেনারকে জানান, “এখন এক হাজার টাকার নোট দেখলেই ভয় লাগে। নতুন নোট দেখলে ওই ভয় আরও বেড়ে যায়। কারণ ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি জালনোট নিজের অজান্তেই গ্রহণ করেছি।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।