জঙ্গি হামলায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও মরদেহ হস্তান্তর
2016.07.04
জঙ্গি হামলায় নিহত ২২ দেশি-বিদেশি নাগরিককে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে বিদায় জানানো হয়েছে। আর হামলাকারি পাঁচ জঙ্গির মরদেহ পরিবার ও স্বজনেরা নিতে চাইছে না, ওগুলো পড়ে আছে হাসপাতালের হিমাগারে।
ওই ঘটনায় নিহত পাঁচ হামলাকারীসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে গতকাল সোমবার রাতে সন্ত্রাসদমন আইনে গুলশান থানায় মামলা হয়েছে। উল্লেখ্য, এর আগে ছয় জঙ্গি মারা যাওয়ার কথা বলা হলেও একজন ছিল হোটেলের কর্মী।
গত শুক্রবার রাত পৌনে নয়টার দিকে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হত্যাযজ্ঞ চালায় জঙ্গিরা। ১২ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর জিম্মি সংকটের রক্তাক্ত অবসান ঘটে শনিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে সেনা নেতৃত্বাধীন সমন্বিত অভিযানের মাধ্যমে।
ওই ঘটনায় নৃশংসভাবে নিহত হন ১৭ বিদেশি নাগরিক, দুই বাংলাদেশি, একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও দুই পুলিশ কর্মকর্তা।
এঁদের স্মরণে সরকার ঘোষিত দুদিনের জাতীয় শোকের শেষদিনে গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে নিহতদের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পন করা হয়। এরপর তিনটি মরদেহ হস্তান্তর করা হয় পরিবারের কাছে।
১৭ বিদেশির মধ্যে সাতটি মরদেহ গতকালই জাপানের উদ্দেশে নেওয়া হয়েছে। ইতালির নয় নাগরিকের মরদেহ আজ মঙ্গলবার দুপুরের আগে দেশের উদ্দেশে পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে ভারতীয় নাগরিক তারিশি জৈনের মৃতদের গতকালই দিল্লিতে নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামে আয়োজিত এই শোকাবহ অনুষ্ঠানে কোনো বক্তৃতা ছিল না। অংশগ্রহণকারিরা বিনম্র শ্রদ্ধা জানান পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সর্বস্তরের নাগরিক দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্মরণ করেন অকারণে নিহত এসব ব্যক্তিদের।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের দুই নাগরিক ফারাজ আইয়াজ হোসেন ও ইশরাত আকন্দ এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অবিন্তা কবীরের মরদেহ তাঁদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন। বাকি ১৭ জন বিদেশির মরদেহ সেখানে নেওয়া হয়নি।
ফারাজ ও ইশরাতের কফিন আবৃত করা ছিল বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা দিয়ে। অবিন্তার কফিন আবৃত করা ছিল বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা দিয়ে।
প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ১৪ দল, জাতীয় পার্টি, ১১ দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নিহতদের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে।
ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে গুলশানের রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন সর্ব স্তরের মানুষ। জুলাই ৪, ২০১৬। ফটো ক্রেডিটঃ ইয়াসিন কবির জয়।
প্রধানমন্ত্রী ১০ টা ২ মিনিটে সরকারের পক্ষে আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি মরদেহগুলো সামনে রেখে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।
তার আগে সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বিদেশে থাকায় তাঁর পক্ষে কমান্ডার মিনহাজ আলম নিহত ব্যক্তিদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে নিহতদের স্বজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সান্ত্বনা দেন। প্রধানমন্ত্রী নিহত অপর চারটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গেও কথা বলেন।
নিহতদের কফিনে ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট, জাপানের রাষ্ট্রদূত মাসাতো ওয়াতানাবে ও ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা পৃথকভাবে শ্রদ্ধা জানান।
সেখানে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সব রকম সহায়তা দিতে প্রস্তুত থাকার কথা জানান যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট।
ভারতের রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বেনারকে বলেন, “প্রতিবেশী, বন্ধু এবং উন্নয়ন সহযোগী হিসাবে বাংলাদেশের যে কোনো সংকটে পাশে থাকবে ভারত।”
রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর দুপুর ১২টা পর্যন্ত সর্বস্তরের সাধারণ জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মঞ্চ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সেখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ১৪ দল, ১১ দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। ঢাকার দুই মেয়র আনিসুল হক ও সাঈদ খোকন পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
বিএনপির শ্রদ্ধা নিবেদন
বিরোধী দল বিএনপির পক্ষে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে আবদুল্লাহ আল নোমান, রুহুল কবির রিজভী, মাহবুবউদ্দিন খোকন প্রমুখ নিহতদের কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
তদন্তের হালচাল
ওই হামলা থেকে বেঁচে ফেরা ১৩ জনের কয়েকজনকে তিনদিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করছে তদন্ত সংস্থাগুলো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, গুলশানের হোলি বেকারিতে হামলা ও হত্যাযজ্ঞের তিন দিনেও এই তদন্তের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। কর্মকর্তারা বলছেন, কারা এই হামলার নেপথ্যের ব্যক্তি সেব্যা পারে কিছুই জানতে পারছেন না তাঁরা।
তবে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক গতকাল সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, “গুলশানের ঘটনায় সন্দেহভাজন দুই জনকে আটক করা হয়েছে। চিকিৎসা শেষে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”
নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার স্মরণে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আয়োজিত শোকসভার পরে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন আইজিপি।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে পুলিশ যাদেরকে জঙ্গি হিসেবে গ্রেপ্তারের কথা বলছে তাদের একজন জাকির হোসেন ওরফে শাওন ওই রেস্তোরাটিরই কর্মী। যাকে শুক্রবার রাতেই রক্তাক্ত অবস্থায় আটক করা হয়।
চার হামলাকারীর পরিচয় মিলেছে
গুলশানের রেস্তোরাঁয় জিম্মি উদ্ধার অভিযানে নিহত সন্দেহভাজন হামলাকারীদের চারজনের পরিচয় জানা গেছে। এঁদের মধ্যে দুজন দীর্ঘ সময় নিখোঁজ ছিলেন। তাঁদের পরিবার থানায় জিডিও করেছিল। একজনের পরিচয় এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
যে চারজনের পরিচয় পাওয়া গেছে তাঁরা হলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, স্কলাসটিকা থেকে ও লেভেল পাস করা মীর সামেহ মোবাশ্বের, মালয়েশিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নিবরাস ইসলাম, বগুড়ার একটি মাদ্রাসার ছাত্র খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল ও জেএমবি সদস্য বগুড়ার শফিকুল ইসলাম উজ্জল । নিবরাস ইসলাম আগে ঢাকার টার্কিশ হোপ স্কুল ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন।
পুলিশ বলছে, বগুড়ার খায়রুলই গুলশানে হামলার নেতৃত্ব দিয়েছে। এর আগে উত্তরবঙ্গে অন্তত তিনটি হত্যায় জড়িত ছিল সে।
এদিকে মোবাশ্বেরের বাবা হায়াত কবীর বেনারকে বলেন, “আমি জাতির কাছে ক্ষমতা চাই। এই পরিস্থিতিতে আমি কীভাবে ছেলের মরদেহ চাইব?” তিনি বলেন,এখন দাফন অনুষ্ঠান আয়োজন করা সম্ভব নয়। এখনকার পরিস্থিতিতে কেউ ওর জানাজায় অংশ নেবে বলেও মনে হয় না।
তবে নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক নিহত এক জঙ্গির ভাই বেনারকে বলেন, পুলিশের হয়রানির ভয়ে তাঁরা লাশ চাইছেন না। কারণ লাশ চাইতে গিয়ে এক জঙ্গির বাবাকে পুলিশ আটক করেছে। এতে অন্যরাও ভয়ে আছেন।
থানায় মামলা
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় হামলার ঘটনায় সোমবার রাতে গুলশান থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
“ওই মামলায় নিহত পাঁচ হামলাকারীসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে,” বেনারকে জানান পুলিশের গুলশান বিভাগের সহকারী কমিশনার রফিকুল ইসলাম।