গুলশান হামলার আটক জঙ্গি নিয়ে ধূম্রজাল,নিহত জঙ্গিদের সবাই সনাক্ত

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.07.08
20160708-BD-Suspects1000.jpg ছবি হাতে শাওনের বাবা-মা আর্টিজানের সামনে ছেলেকে খুঁজতে আসেন।হামলার রাতেই জাকির হোসেন শাওনকে রক্তাক্ত অবস্থায় সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করে পুলিশ। জুলাই ৪, ২০১৬।
এএফপি

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর সেনা সদর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রথমে একজন সন্দেহভাজন আটকের দাবি করা হয়। পরে পুলিশ দুজন সন্দেহভাজন জঙ্গিকে জীবিত আটকের দাবি করে। তবে এক সপ্তাহ পার হলেও এখন পর্যন্ত আটকদের কারও পরিচয় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না করায় এ নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে।

এর মধ্যে গুলশান হামলায় আহত হয়ে পুলিশ প্রহরায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় হলি রেস্তোরাঁর কর্মী জাকির হোসেন শাওন গতকাল শুক্রবার মারা গেছেন।

তবে ওই ঘটনায় নিহত ছয় সন্দেহভাজন হামলাকারীর পরিচয় শনাক্ত করেছে তাদের পরিবার।

গুলশান হামলার পর গত ২ জুলাই সেনা সদর দপ্তর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, হলি আর্টিজান বেকারি থেকে জিম্মিদের উদ্ধারে চালানো ‘অপারেশন থান্ডার বোল্টে’ ছয় জঙ্গি নিহত হয়েছে এবং একজন সন্দেহভাজন জঙ্গিকে জীবিত আটক করা হয়েছে।

ওইদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে একজন সন্দেহভাজন জঙ্গিকে জীবিত আটকের কথা উল্লেখ করেন।

তবে গত সোমবার গুলশানের ঘটনায় নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার শোকসভায় পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, গুলশানের ঘটনায় সন্দেহভাজন দুই জনকে আটক করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

এদিকে গত বুধবার ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ও ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের আতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “গুলশান ঘটনার মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া কেউ আমাদের হেফাজতে নেই। তবে চারজন সন্দেহভাজন রয়েছেন। এদের দুজন রেস্তোরাঁর কর্মী। আর দুজন জিম্মি অবস্থা থেকে বেঁচে ফিরে আসা ব্যক্তি।”

কিন্তু এখনও পর্যন্ত আটক কোনো সন্দেহভাজন জঙ্গির পরিচয় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি।

“প্রশ্ন হলো, ‘ঘটনাস্থল থেকে আটক’ ব্যক্তি সম্পর্কে পরে আর কোনো ঘোষণা আসেনি। তিনি কোথায়?” প্রশ্ন রেখেছেন ঢাকার সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান।

গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোর অনলাইনে প্রকাশিত এক লেখায় তিনি উল্লেখ করেন, “তাঁকে বা এই ঘটনায় কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে এ পর্যন্ত আদালতে সোপর্দ করা হয়নি।”

এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “অথচ বাংলাদেশ সংবিধানের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা হলো, কেউ ‘আটক’ হন আর ‘গ্রেপ্তার’ হন, তাঁকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচার বিভাগে সোপর্দ করতে হবে।”

নিহত শাওন জীবিত জঙ্গি

একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বেনারকে জানিয়েছেন, শুক্রবার মারা যাওয়া শাওনকে আটক ‘জীবিত জঙ্গি’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল। গুলশান হামলার রাতেই তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় আটক করে পুলিশ। তার শরীরে বোমার স্প্লিন্টার লেগেছিল।

দেশের গণমাধ্যমগুলোর খবরেও বলা হয়েছে, শাওন ছিল কথিত জীবিত জঙ্গি।

“আহত অবস্থায় পুলিশ শাওনকে ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন চালায়। নির্যাতনে অনেকটা অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়েছিল সে,” বেনারকে জানান শাওনের বাবা আবদুস সাত্তার।

তিনি জানান, শাওন হলি আর্টিজান বেকারিতে বাবুর্চির সহকারি ছিল। সে জঙ্গি ছিল না।

গত ৪ জুলাই শাওনের মা-বাবা ছেলেকে খুঁজতে আর্টিজানের সামনে ছবি নিয়ে গিয়েছিলেন। হামলার পর থেকে জাকির হোসেন শাওনকে তাঁরা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তার (জাকির) খোঁজে অভিভাবকেরা কয়েকবার গুলশান থানার পুলিশের কাছে গেছেন। ৩ জুলাই রাত দেড়টা পর্যন্ত তাঁরা গুলশান থানায় বসে ছিলেন। কিন্তু পুলিশ তার কোনো খোঁজ দিতে পারেনি।

ওই দিন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহীদুল হক জানান, হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন দুই জঙ্গি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে তিনি কারও নাম-পরিচয় প্রকাশ করেননি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শাওনকে ৩ জুলাই রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল সূত্রের দাবি, তাকে হাতকড়া পরিয়ে সেখানে নেওয়া হয়। গতকাল চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়।

আসামিদের সবাই মৃত

গুলশান হামলার তিনদিন পর গত সোমবার গুলশান থানায় পুলিশের দায়েরকৃত মামলায় ছয়জনকে আসামি করা হয়।মামলার ছয় আসামিই সেনা সমন্বিত অভিযানে নিহত হয়।

মামলায় বলা হয়েছে, এই ছয়জননের মধ্যে পাঁচজন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্য। এরা হচ্ছে; মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিরবাস ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল।

আর সাইফুল ইসলাম নামে নিহত আরেকজন ওই রেস্তোরাটির কর্মী হলেও সে জঙ্গিদের সহায়তা করে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।

পরিবার সনাক্ত করেছে ৫ নিহত জঙ্গিকে

গুলশান হামলায় নিহত পাঁচ জঙ্গির লাশ শনাক্ত করেছে পরিবার। নিহতদের ছবি ও জঙ্গি সংগঠন আইএসের প্রকাশিত ছবি দেখে সন্তানের লাশ শনাক্ত করে তাদের মা–বাবা ও স্বজনেরা।

নিহত জঙ্গি নিবরাস ইসলামের বাবা নজরুল ইসলাম ঢাকার একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ি। বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় পাঠানো হাতে লেখা চিঠিতে তিনি তাঁর সন্তানের এহেন কর্মের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।

ওই চিঠিতে নজরুল বলেছেন, গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে নিখোঁজ ছিল নিবরাস। তাঁরা পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে ধর্ণা দিয়েও শেষ পর্যন্ত নিবরাসের খোঁজ বের করতে পারেননি।

গুলশানের ঘটনায় নিহত আরেক সন্দেহভাজন জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজের বাবা আওয়ামী লীগের নেতা এস এম ইমতিয়াজ খান বাবুলও জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি হত্যার শিকার বিদেশী নাগরিকদের স্বজনদের কাছেও ক্ষমা চান।

একই ঘটনায় নিহত আরেক সন্দেহভাজন মীর সামেহ মোবাশ্বের গত ২৯ ফেব্রুয়ারি নিজেদের গাড়িতে করে কোচিংয়ে যাওয়ার কথা বলে বনানীর ডিওএইচএসের বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি।

তার বাবা মীর এ হায়াৎ কবির বেনারকে বলেন, “সামেহ স্কলাস্টিকা স্কুল থেকে ও লেভেল পাস করেছে। এ লেভেল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। যেদিন সামেহ নিখোঁজ হয়, সেদিন গুলশানের আজাদ মসজিদের পাশে একটি কোচিং সেন্টারে তার যাওয়ার কথা ছিল”। মীর এ হায়াৎ কবির একটি টেলিকম প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে চাকরি করেন।

হায়াৎ কবির বলেন, সামেহ নিখোঁজ হওয়ার পরে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েকদফা যোগাযোগ করেছেন তিনি। গোয়েন্দারা কিছু ভিডিও ফুটেজ যোগাড় করে তাঁকে দেখিয়েছিলেন। তাতে দেখা গেছে, গুলশানে আগোরার পাশে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে সে একটি রিকশায় করে বনানী ১১ নম্বরের দিকে যাচ্ছে। এরপর মুঠোফোনে বা অন্য কোনো মাধ্যমে সে পরিবারের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।

ওই জঙ্গিদের আরেকজন খায়রুল ইসলাম পায়েলের বাড়ি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার চুতিনগর ইউনিয়নের ব্রিকুষ্টিয়া গ্রাম। দিনমজুর আবু হোসেন ও পেয়ারা বেগম দম্পতির বড় ছেলে খায়রুল। আবু হোসেন ও পেয়ারা বেগম ছেলের ছবি দেখে শনাক্ত করেছেন।

খায়রুলের মা পেয়ারা বেগম স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, “এক বছর ধরে খায়রুল নিখোঁজ ছিল। স্থানীয় পত্রিকার লোকজনের কাছে হারানো বিজ্ঞপ্তি ছাপানোর জন্য গিয়েছিলেন। কিন্তু থানায় জিডি করতে হবে শুনে তাঁরা আর হারানো বিজ্ঞপ্তি দেননি।”

নিহত আরেজন শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বলের বাড়ি বগুড়ার ধুনটের কৈয়াগাড়ি গ্রামে। শফিকুলের বাবা বদিউজ্জামান (৫৫) ও বড় ভাই আসাদুল ইসলাম (৩২) কৃষক।

বাবা বদিউজ্জামান স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, ধুনটের একটি স্কুল থেকে এসএসসি ও স্থানীয় গোসাইবাড়ি ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে উজ্জ্বল। এরপর বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হলেও পড়ালেখা ছেড়ে দুই বছর আগে ঢাকায় চলে যায়। ঢাকার আশুলিয়ায় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেয়।”

তিনি জানান, সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বরে শফিকুল বাড়িতে গিয়েছিল।  তাবলিগ জামাতের চিল্লায় যাওয়ার কথা বলে বাড়ি ছাড়ে সে। এরপর শফিকুল বাড়ির আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। তাঁরা পুলিশের নিয়ে যাওয়া ছবি দেখে উজ্জ্বলকে শনাক্ত করেছেন।

পুলিশ বলছে জঙ্গি সহযোগি; পরিবারের না

গুলশানের ঘটনায় জঙ্গিদের সহযোগী হিসেবে মামলার আসামি করা হয়েছে হলি আর্টিজান বেকারির নিহত কর্মী সাইফুল ইসলাম চৌকিদারকে। তবে তাঁর বোন ময়না বেগম স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, সাইফুল কখনোই জঙ্গি ছিল না। সে দেড় বছর ধরে ওই রেস্তোরাঁয় কাজ করছিল।

এদিকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে সাইফুলসহ অন্য পাঁচজনের লাশ রাখা হয়েছে। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে লাশ চাওয়া হচ্ছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিহত এক জঙ্গির ভাই বেনারকে বলেন, “লাশ চাইলে পুলিশ হয়রানি করে কিনা, সেই ভয়ে আমরা লাশ চাইছি না।”

শোলাকিয়ার ঘটনায়ও জঙ্গি সম্পৃক্ততা!

গুলশানে হামলার ঠিক ছয়দিন পর গত বৃহস্পতিবার ঈদের দিনে শোলাকিয়ার হামলায়ও একই চক্র জড়িত বলে পুলিশের পক্ষ থেকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় স্পষ্ট করে কোনো জঙ্গি সংগঠনের নাম বলা হয়নি।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঢাকা রেঞ্জের ডিআিইজি মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, যে চক্রটি গুলশানের হামলার সঙ্গে জড়িত তারাই এ হামলা চালাতে পারে।

এদিকে গুলশানে হামলার দায় স্বীকার করে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস নিজেদের কথিত বার্তা সংস্থা ‘আমাক নিউজে’ সংবাদ প্রকাশ করলেও শোলাকিয়ায় হামলার দায় গতকাল পর্যন্ত স্বীকার করেনি।

তবে ওই হামলার সঙ্গে জড়িত দুজন ও নিহত একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। হামলায় নিহত যুবক আবির রহমান বলে নিশ্চিত করেছেন কিশোরগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মীর মোশাররফ হোসেন।

ঢাকার ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থেকে পাস করে আবির নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছিল। কয়েকমাস আগে আবির নিখোঁজ হয়। তাদের বাসা ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। তবে শুক্রবার পর্যন্ত আাবির রহমানের লাশ শনাক্ত করেনি তার পরিবার। ওই ঘটনায় ধরা পড়া অন্য দুজন হচ্ছে; শরীফুল ইসলাম ওরফে আবু মুকাতিল ও জাহিদুল হক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।