গুলশানে রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা,দেশি–বিদেশি নাগরিক জিম্মি,দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.07.01
160701_BD_ATTACK_1000.jpg ঢাকার গুলশানে স্প্যানিশ হোটেল হলি আর্টিজান বেকারিতে শুক্রবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলার পর আহতদের বের করে আনা হচ্ছে।জুলাই ০২, ২০১৬।
এএফপি

একদল দুর্বৃত্ত আল্লাহু আকবরবলে ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস ও বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে। এতে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত, পুলিশ ও দেশিবিদেশী নাগরিকসহ প্রায় অর্ধশত আহত হয়েছেন।

অভিজাত এই স্প্যানিশ রেস্তোরাঁয় গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতরা হলেন; বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন এবং গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারি কমিশনার হাবিবুল ইসলাম।

অস্ত্রধারীদের হামলার পর হলি আর্টিজান বেকারি নামে এই স্প্যানিশ রেস্তোরাঁয় বেশ কিছু মানুষ আটকা পড়েছেন। এদের মধ্যে সশস্ত্র হামলাকারি ও জিম্মি হওয়া নিরীহ লোকজন আছেন। তবে ভেতরে মোট কতজন আটকা পড়েছেন সে সম্পর্কে রাত একটা পর্যন্ত স্পষ্ট ধারনা পাওয়া যায়নি।

সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা হোটেলটির আশপাশের চার কিলোমিটার এলাকা ঘিরে রেখেছে বিপুলসংখ্যক র‍্যাব-পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

গুলশান ২ নম্বরের কাছে ওই বেকারিতে কারা এবং কেন হামলা চালিয়েছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য এখন পর্যন্ত পুলিশ দিতে পারেনি। তবে বরাবরের মতই জঙ্গিদের ওপর সন্দেহ করা হচ্ছে র‍্যাব–পুলিশের পক্ষ থেকে।

ইতিমধ্যে ঘটনার দায় স্বীকার করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস (ইসলামিক স্টেট)। শুক্রবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে (বাংলাদেশ সময়) আইএস এর কথিত সংবাদ সংস্থা আমাক নিউজের বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সাইট ইন্টিলিজেন্স এ খবর দিয়েছে। যদিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হচ্ছে, এ দেশে আইএসের অস্তিত্ব নেই।

“বন্দুকধারীরা উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর সদস্য বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে। তবে তারা কোন গোষ্ঠীর সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে সময় লাগবে। তা ছাড়া সবার দৃষ্টি আগে ওই জিম্মি ঘটনা শেষ করা এবং সবাইকে অক্ষত অবস্থায় বের করে আনা,” বেনারকে জানান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম।

এদিকে ঢাকায় এই বর্বরোচিত হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য দূতাবাসের পক্ষ থেকে গতকালই নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা ও সাবধানে চলাফেরা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

গুলশান এলাকাসহ রাজধানীর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। লেকভিউ ক্লিনিকের খুব কাছে ৭৯ নম্বর রোডের ওই এলাকা ঘিরে রেখেছে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি সদস্যরা। আকাশে টহল দিচ্ছে র‌্যাবের হেলিকপ্টার।

এ ঘটনার তিন ঘন্টা পর ব্যাবের অনুরোধে টেলিভিশনে ঘটনার সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রাত ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে র‍্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, “জনস্বার্থে এবং আতঙ্ক কমাতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমরা হামলাকারিদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাই। ঘটনার সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি করতে সব ধরণের চেষ্টা করা হচ্ছে।”

“যারা ওখানে ঢুকেছে অস্ত্রসহকারে, তাদের সঙ্গেও আমরা যোগাযোগ স্থাপন করতে চাই, তাদের কী সমস্যা সেটা আমরা শুনতে চাই। আমরা এটাকে পিসফুলি রিজলভ করতে চাই,” জানান বেনজীর আহমেদ।

এদিকে বেকারিতে জিম্মি হয়ে পড়াদের মধ্যে আনুমানিক ২০ জন বিদেশি নাগরিক বলে জানিয়েছেন বেকারির সুপারভাইজার সুমন রেজা।

সাংবাদিকদের তিনি বলেন, রাত পৌনে নয়টার দিকে আট থেকে ১০ জন যুবক অতর্কিতে আর্টিজানে ঢুকে পড়ে। তাদের একজনের হাতে ছিল তলোয়ার, বাকিদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র। ঢুকেই তারা কয়েকটি ফাঁকা গুলি করে এবং ‘আল্লাহু আকবর’ বলে চিৎকার করে। তখন ভেতরে ২০ জনের মতো বিদেশি নাগরিক ছিলেন।

সুমন নিজে ও আর্টিজানের আরেকজন কর্মী (ইতালির নাগরিক) দোতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে বাইরে আসতে সক্ষম হন।

সুমন বলেন, “আমি ছাদে ছিলাম। ওরা ১০-১২টা বোমা মারছে। আমরা তখন  ছাদ থেকে লাফ দেই।”

ঘটনার পর রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিকে ভর্তি করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে তিনজনকে ভর্তি করা হয়েছে, যাঁদের দুজন পুলিশ এবং একজন গাড়িচালক।

“আমি চারজন জাপানি নাগরিককে নিয়ে ওই বেকারিতে গিয়েছিলাম। তাঁরা ভেতরে ঢোকার পর আমি বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। সন্ত্রাসীরা হঠাৎ এসে আমাকে গুলি করে। এ সময় দুজন টহল পুলিশ এগিয়ে এলে তাদেরও গুলি করে,” বেনারকে জানান গাড়িচালক আব্দুর রাজ্জাক (২৩)।

এদিকে বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিনকে রক্তাক্ত অবস্থায় ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাঁকে  মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশের সহকারি কমিশনার হাবিব গুরুতর আহত হয়ে পরে মারা যান।

ওই রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসীদের হানা দেওয়ার প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর রাত ১২টায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত রেস্তোরাঁর ভেতরে বা এর গলির মধ্যে এখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ ঢুকতে পারেনি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, রেস্তোরাঁর আলো বন্ধ রয়েছে। সেখান থেকে কিছুক্ষণ পর পর আসছে গুলির শব্দ। ভেতরে দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ জিম্মি হয়ে আছেন।

ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থাকা একাধিক সাংবাদিক বেনারকে জানান, হোটেলের আশপাশে ব্যাপকসংখ্যক পুলিশ-র‍্যাব, সোয়াত, ডিবি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়েছেন।

তাঁরা প্রত্যেকই বুলেট প্রুফ জ্যাকেট এবং বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর সদস্যরা গ্রেনেড শিল্ড, বুলেট শিল্ড, দরজা ভাঙার জিনিসপত্র ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘটনাস্থলে রয়েছেন।

এর আগে পুলিশের একটি দল হ্যান্ডমাইক নিয়ে ওদের কাছাকাছি গেলে তাঁদের লক্ষ্য করে জিম্মিকারীরা গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এ সময় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন।

সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের পরামর্শ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে চায়।

তবে আলোচনা না অপারেশনের মাধ্যমে এই ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটবে, সেই সিদ্ধান্ত রাত একটা পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। যদিও র‍্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেছেন, প্রতিটি জীবন মূল্যবান। তাঁরা প্রথমে আলোচনার মাধ্যমে এই জিম্মি অবস্থার অবসান চাইবেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।