গুলশান হামলার পৃষ্ঠপোষকেরা শনাক্ত,তদন্তে আরও অগ্রগতি
2016.08.22

গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় অংশ নেওয়া পাঁচজনই নিহত হয়েছে, পরিকল্পনাকারীরা চিহ্নিত হয়ে আছে বলে পুলিশের দাবি। খুব শিগগির এই মামলার বড় অগ্রগতি ঘটবে বলে সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে আশা করা হচ্ছে।
পুলিশ বলছে, হামলায় অংশ নেয়া নিহত পাঁচজনের সবাই ‘নিউ জেএমবি’ নামে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। ওই ঘটনার পরিকল্পনাকারী অন্তত সাতজনকে শনাক্ত করার কথা বলা হলেও নুরুল ইসলাম মারজান ছাড়া কারও নাম–পরিচয় প্রকাশ করেনি পুলিশ।
এ পর্যন্ত পুলিশের প্রাপ্ত তথ্য হচ্ছে, কথিত ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার দাবির অংশ হিসেবে ওই বর্বরোচিত হামলা চালানো হয়েছিল।ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া ও জনসংযোগ বিভাগের মুখপাত্র মো. মাসুদুর রহমান বেনার নিউজকে এ কথা জানান।
আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসর মতো হামলাকারীদের উদ্দেশ্য গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতের মাধ্যমে ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠা করা। তারা মনে করে আইএসের বর্তমান খলিফা আবু বকর আল বাগদাদী তাদের নেতা।
এর আগে গত রোববার পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “গুলশানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় মদদদাতা, পৃষ্ঠপোষক এবং অর্থের যোগানদাতাদের গ্রেপ্তার করাটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাদের সংখ্যা সাত থেকে আটজন।”
তবে সোমবার পর্যন্ত তাদের কাউকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ওই ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত একমাত্র আসামি ব্রিটিশ নাগরিক ও নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিম। তাকে দ্বিতীয় দফা রিমান্ডের পর গতকাল সোমবার কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ বলছে, তার কাছ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, সেগুলো যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রয়োজনে আবারও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
গত ১২ আগস্ট হামলার প্রায় দেড় মাস পর পুলিশ ‘মারজান’ নামের এক তরুণের ছবি ও পরিচয় প্রকাশ করেছে। মারজানের মুঠোফোন থেকে হামলার রাতে হলি আর্টিজানে হত্যাযজ্ঞের ছবি আইএসর মুখপাত্র ‘আমাক’ এ পাঠানো হয়েছিল।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “ওই হামলার পর আইএস আছে কি নেই, সেই বিতর্কে যাওয়ার অর্থ হয় না। আইএস কোনো সংগঠন নয়, এটা হচ্ছে একটি আদর্শ এবং এই আদর্শের উপস্থিতি বাংলাদেশে আছে।”
তাঁর মতে, হলি আটির্জানের হামলায় প্রমাণ হয় যে, আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের জেএমবি বা অন্য কোনও জঙ্গিগোষ্ঠীর যোগসূত্র আছে।
মারজান, তামিম, রিপন ও রাজিব
মারজান পুলিশের গোয়েন্দা জালে আছে বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে তাকে গ্রেপ্তারের খবর পুলিশ নিশ্চিত করেনি।
ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে তামিম চৌধুরীর পাশাপাশি ‘রিপন’ ও ‘রাজিব গান্ধী’ (সাংগঠনিক নাম) নামে দুই প্রভাবশালী জেএমবি সদস্যের নাম এসেছে। কল্যাণপুরের ‘জঙ্গি’ আস্তানায় পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনায় মিরপুর থানায় দায়ের হওয়া মামলায় তামিম চৌধুরীর পাশাপাশি এ দুজনকেও আসামি করা হয়েছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘তামিম চৌধুরী নজরদারিতে আছে, বাংলাদেশেই অবস্থান করছে’।
কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তা আরও একধাপ এগিয়ে বলেছেন, তামিম চৌধুরী রিকশায় চলাচল করে, নাক-মুখ ঢাকা মাস্ক ব্যবহার করে এবং গ্রেপ্তার এড়াতে ঘন ঘন স্থান বদল করছে। এত তথ্য হাতে থাকার পরও তামিম কেন গ্রেপ্তার হচ্ছেন না এমন প্রশ্নের সদুত্তর অবশ্য পাওয়া যায়নি।
মারজানের সূত্রেও হামলার কোন পর্যায়ে কারা জড়িত ছিল, সে সম্পর্কিত তথ্য পাওয়ার কথা দাবি করছে পুলিশ। কিন্তু তার অবস্থান সম্পর্কে পুলিশ কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। দুজনেই ‘গোয়েন্দা জালে’ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।
২৪ আগস্ট গুলশান হামলার ব্যাপারে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়ার কথা।
হামলাকারীর সংখ্যা পাঁচ এবং প্রত্যেকেই নিহত, তাহলে এ হামলা সম্পর্কে পুলিশ বিস্তারিত জানতে পারছে কি করে? এমন প্রশ্নের জবাবে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. ছানোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “হামলার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন করা নেতাদের একটি বড় অংশ এখন পুলিশের কাছে। তারাই এই তদন্তের একটি বড় সূত্র।”
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান এক দশক জঙ্গিবাদ নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বেনারকে বলেন, “গুলশান হামলায় গোটা পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এই তদন্ত নির্ভুল ও স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। কোনো বিষয়ে সামান্য লুকোচুরি তদন্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাশাপাশি এর গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করতে পারে।”
আনসার আল ইসলামের সম্পৃক্ততা নেই
আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা বা একিউআইএস এর শাখা হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। ব্লগার, বিজ্ঞান লেখক, ভিন্ন মতাবলম্বীদের খুনে সম্পৃক্ততার এই দলটির সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক এই দলটির প্রধান। তবে, গুলশানের হলি আর্টিজানের হামলায় এই দলটির সম্পৃক্ততার প্রমাণ এখনো পুলিশ খুঁজে পায়নি বলে জানিয়েছে।
সমন্বয়হীনতার বলি হাসনাত, তাহমিদ!
গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলায় গ্রেপ্তারকৃত আসামি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিম ও তাহমিদ হাসিব খান কারাগারে আছেন।
কোনো কোনো সূত্র বলছে, হাসনাত করিম ও তাহমিদ হাসিব খান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার বলি।
হাসনাত করিমের বাবা রেজাউল করিম বেনারকে বলেন, “সর্বশেষ হাসনাতের সঙ্গে আমার বউ মা (শারমিনা পারভীন) এর দেখা হয় ১৩ জুলাই। সেদিন ডিবি কার্যালয়ে তার সঙ্গে আমার বউ মা মিনিট পাঁচেক কথা বলার সুযোগ পান। এরপর আমরা আর তার কোনো খবর পাইনি।”
এরপর গত ৩ আগস্ট হাসনাতকে প্রথমে ৫৪ ধরায় গ্রেপ্তার ও পরে ১৩ আগস্ট মামলার আসামি করা হয়। তার স্ত্রী শারমিনা পারভিন স্বামীকে মামলার আসামি করায় হতাশা প্রকাশ করেন। বাবা রেজাউল করিম গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ দিকে কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাহমিদ হাসিব খানের বাবা শাহরিয়ার করিম আগাগোড়াই ছেলের আটকাবস্থা, ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানো সম্পর্কে কোনো কথা বলেননি। ছয় দিনের রিমান্ড শেষে তাহমিদকে কারাগারে পাঠানোর পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
মূলত এ দুজনকে ঘিরে সন্দেহের সূত্রপাত হয় অনলাইনে প্রকাশিত তিনটি ছবি থেকে। ছবিগুলোতে দেখা যায় জিম্মি সঙ্কটের সময় হাসনাত ও তাহমিদ এক জঙ্গির সাথে কথা বলছে। এ সময় তাহমিদের হাতেও অস্ত্র ছিল।
কয়েকটি গণমাধ্যমে ওই ছবি প্রকাশ করে বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের বেনামি বরাত দিয়ে দাবি করা হয়, ঘটনার সঙ্গে তাহমিদ ও হাসনাতের যুক্ত থাকার বিষয়ে নানা তথ্য-প্রমাণ কর্মকর্তাদের হাতে এসেছে।
এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও ৭ আগস্ট বলেন, “মোটামুটি নিশ্চিত হওয়ার পরই হাসনাত রেজা করিম ও তাহমিদ হাসিব খানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।” গত শনিবার হাসনাতকে গুলশান হামলার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
তবে ৭ আগস্ট কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “কী পরিস্থিতিতে হাসনাত করিম ও তাহমিদ হাসিব খানের হাতে অস্ত্র ছিল, কী পরিস্থিতিতে তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এমন হয়েছে, এটা বিশ্লেষণ করে প্রাপ্ত তথ্য মিলিয়ে দেখা হচ্ছে।”
আইএস আছে-আইএস নেই
বাংলাদেশ সরকার দেশের ভেতর আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই বলে দাবি করে আসছে। এই দাবিতে চিড় ধরে এ বছরের এপ্রিলে। ওই সময়ে আইএসের মুখপাত্র দাবিকে আবু ইব্রাহীম আল হানিফ নামে এক ব্যক্তির দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। সেখানে তিনি নিজেকে বাংলাদেশে আইএসের আমির বলে পরিচয় দেন।
কানাডার উইন্ডসোরের বাসিন্দারা কথিত ওই আমিরকে তামিম চৌধুরী বলে চিহ্নিত করেন। সাক্ষাৎকার ছাপার তিন মাসের মাথায় গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা হয় এবং পুলিশ জানায়, ওই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরী।
মনিরুল ইসলাম বলেন, ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর তামিম বাংলাদেশে আসেন। তিনি জেএমবির নতুন অংশটির নেতৃত্বে রয়েছেন।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে ৫০০ বোমা ফাটিয়ে অস্তিত্বের জানান দেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠাতা ও শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তার, পরের বছর ফাঁসি কার্যকর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার মুখে সংগঠনটি একরকম ভেঙে যায়। প্রায় ১১ বছর পর জেএমবি গুলশানের হলি আর্টিজানে পুনরুত্থানের জানান দেয়।
পুলিশের দাবি, এই জেএমবি নিজেদের আইএস বলে দাবি করছে। আবার আইএসের সঙ্গে নব্য জেএমবির সম্পর্ক কতটা তা নিয়ে বিভিন্ন রকম বক্তব্য আছে।
“এ দেশে আইএস নেই। কিন্তু স্থানীয় জঙ্গিরা আইএসের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ,” বেনারকে জানান বেসামরিক পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।
পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক মনিরুজ্জামান বেনারকে বলেন, “আমরা জেএমবির সঙ্গে যুক্ত আছে বা ছিল, এমন ব্যক্তিদের একটি তথ্য ভান্ডার তৈরি করেছি। সম্প্রতি আইএস ফরেইন ফাইটার্সদের একটি তালিকা পাওয়া গেছে। তাতে কোনো বাংলাদেশির যুদ্ধ করার খবর আমরা পাইনি। বাংলাদেশিরা সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে সেখানে কাজ করছে।”
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ধারণা আইএস বা আল কায়েদা নামে কোনো সংগঠন না থাকলেও তাদের মতাদর্শ অনুসরণ করছে অনেকেই। সম্প্রতি গাজীপুর ও ঢাকায় গ্রেপ্তার চার নারী জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব জানায়, “তারা অনলাইনে আইএস মতাদর্শ সম্পর্কে তথ্য, তত্ত্ব, অডিও, ভিডিও সংগ্রহ ও প্রচার করত।”