গুলশান হামলার অপারেশন কমান্ডার মারজানের পরিচয় মিলেছে
2016.08.15

গুলশান হামলার গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহভাজন অপারেশন কমান্ডার মারজানের পরিচয় পাওয়া গেছে। তার পুরো নাম নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান। পাবনার ছেলে মারজান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী।গত প্রায় আট মাস ধরে নিখোঁজ ছিল সে।
এর আগে গত শুক্রবার মারজানের বিষয়ে তথ্য চেয়ে পুলিশের বিশেষ অ্যাপ ‘হ্যালো সিটি’তে তার ছবি প্রকাশ করা হয়। সেখানে তাকে গুলশান হামলার ‘অপারেশন কমান্ডার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তার বয়স ২২ বা ২৩ বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “হলি আর্টিজানে হামলার পর রাত একটায় ইন্টারনেট-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত ভেতর থেকে জঙ্গিরা হত্যাযজ্ঞের ছবি তোলে। পরে তা মারজানসহ কয়েকজনকে পাঠায়। ওই রাতেই এসব ছবি আইএসের কথিত বার্তা সংস্থা আমাক-এ প্রকাশ করা হয়। মারজান ভারী অস্ত্র চালাতে পারে।” গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় মারজানের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ইউনিট।
পাবনা জেলা পুলিশ জানায়, তার বাড়ি পাবনার হেমায়েতপুরের আফুরিয়া গ্রামে। ১০ ভাইবোনের মধ্যে মারজানের অবস্থান দ্বিতীয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাস করার পর মারজান পুরোনো বাঁশ বাজার আহলে হাদিস কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়।পাশাপাশি একটি দাখিল মাদ্রাসা থেকে আলিম ও ফাজিল পাস করে।
আফুরিয়া গ্রামে মারজানের স্বজন ও প্রতিবেশীরা জানান, এ বছরের জানুয়ারি মাসে মারজান গ্রামে বিয়ে করতে আসে। খালাতো বোনকে বিয়ে করে সেই যে সে গ্রাম ছাড়ে, তারপর থেকে বাড়ির আর কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেনি।
নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান।ফাইল ফটোঃ ডিএমপি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানাচ্ছে, মারজান ২০১৪ সালে আরবি বিভাগে স্নাতক সম্মানে ভর্তি হয়। তবে প্রথম বর্ষের পরীক্ষার আগে থেকেই সে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা ছেড়ে দেয়। ফলে সহপাঠীরা মনে করেছিল, সে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে বা অন্য কোথাও ভর্তি হয়েছে।
“তার সঙ্গে বাড়ির কারও যোগাযোগ নেই। গত কয়েক মাসে সে কোথায়, কি করেছে তা আমরা জানি না। তবে সে কোনো অন্যায় করে থাকলে বিচার হওয়া উচিত। যারা তাকে এ পথে নামিয়েছে তাদেরও বিচার হওয়া দরকার,” বেনারকে জানান মারজানের বাবা নিজামউদ্দিন।
পুলিশ বলছে, গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পর জেএমবির প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে মারজানের বৈঠক হয়। পরবর্তী হামলার জন্য ছকও তৈরি করেছিল। কিন্তু রাজধানীর কল্যাণপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে তাদের সেই ছক ভেস্তে গেছে।
রিমান্ড শেষে হাসনাত গ্রেপ্তার, তাহমিদ ফের রিমান্ডে
এদিকে আট দিনের রিমান্ড শেষে শনিবার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমকে হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রথম কাউকে গ্রেপ্তার করা হলো।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আবদুল বাতেন বলেন, “কোনো ঘটনায় কাউকে সন্দেহ হলে তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়। গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলায় জড়িত থাকার প্রাথমিক সত্যতা মেলায় হাসনাত করিমকে মূল মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”
হাসনাতকে গ্রেপ্তারের পর তার স্ত্রী শারমিনা পারভীন একটি বিবৃতি দিয়েছেন। ওই বিবৃতিতে তিনি বলেন, “হাসনাতকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোয় আমরা হতাশ। তবে আমরা আত্মবিশ্বাসী যে তদন্ত করা হলে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। আমরা তাঁর মুক্তির জন্য কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করে যাব।”
এর আগে পত্র-পত্রিকায় হলি আর্টিজানের ছাদে নিহত জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজের সঙ্গে হাসনাত করিম ও পিস্তল হাতে তাহমিদ হাসিব খানের ছবি প্রকাশ হলে ঘটনার সাথে তাদের সম্পৃক্ততা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠে।
হাসনাত করিমের বাবা রেজাউল করিম বেনারকে বলেন, “আমি নিশ্চিত তদন্ত হলে আমার ছেলে নির্দোষ প্রমাণ হবে। আমরা কর্তৃপক্ষকে যতটা সহযোগিতা করা যায়, তাই করব।”
এ দিকে তাহমিদ হাসিব খানের বাবা শাহরিয়ার করিম যুক্তরাজ্যের একজন বডি ল্যাংগুয়েজ বিশেষজ্ঞের কাছে ছবিটি পাঠিয়ে তাঁর মতামত গণমাধ্যমকে জানান।
বডি ল্যাংগুয়েজ বিশেষজ্ঞ ইন্ডিয়ানা ফোর্ড বলেন, “তাহমিদ যে ঘটনার শিকার তা ছবি তিনটিতে স্পষ্ট। মানুষ বিপন্ন বোধ করলে, চাপে পড়লে এবং জীবন নিয়ে চরম ভয়ের মধ্যে থাকা মানুষ এভাবে দাঁড়ান এবং অস্ত্র স্পর্শকাতর জায়গায় ধরেন। ছবিতে রোহান ইমতিয়াজকে আত্মবিশ্বাসী বলে মনে হচ্ছে। পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে মনে হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, হাসনাত ও তাহমিদ দুজনই মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটছিলেন। হাঁটার এ ভঙ্গিতে ভীতি ও বিপন্নতাই প্রকাশ পেয়েছে।
১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিলেন দুই তরুণী
সত্য প্রকাশ পালের পর রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া আরও দুই তরুণী রোববার ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা দুজনেই তাহমিদ হাসিব খানের বান্ধবী। তাঁদের একজনের নাম মালিহা ফাইরুজ ও অপরজন তাহানা তাসমিয়া।
সূত্র বলছে, ১৬৪ ধারায় ওই দুই নারী একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, তাহানা তাসমিয়াদের বাসা গুলশানে। মালিহা ফাইরুজ সেদিন সকালে ঢাকায় ফেরা তাহমিদ হাসিব খানকে গুলশানে আসতে বলেন। সেখান থেকে তাঁরা তিনজনে রেস্তোরাঁয় ইফতার করতে গিয়েছিলেন।
অগ্রগতির দাবি পুলিশের
গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম। এই বিভাগের সহকারী উপকমিশনার মো. ছানোয়ার হোসেন গতকাল বেনারকে বলেন, “গুলশান হামলার পরিকল্পনাকারী, অস্ত্রের জোগানদাতা ও অর্থদাতা শনাক্ত হয়েছেন। হামলাকারীরা কোন জায়গা থেকে কোথায় গিয়ে উঠেছে সে সম্পর্কে সব তথ্যই আমাদের হাতে এসেছে।”
পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, তামিম চৌধুরী এই হামলার পরিকল্পনাকারী। গুলশানের হলি আর্টিজান, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার ঈদ জামাতে হামলা এবং কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানার সবাই একই দলভুক্ত।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “তামিম চৌধুরী ঢাকায় আছেন। তিনি অনবরত স্থান বদল করছেন। তবে বসুন্ধরা ও শেওড়াপাড়ার যে বাসা দুটিতে জঙ্গিরা ছিল সে বাসা দুটিতেও তার যাতায়াত ছিল। তাকে দ্রুত ধরে ফেলার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।”। তবে, তামিম চৌধুরী পুলিশের জিম্মায় আছে বলে যে প্রচার তা নাকচ করে দিয়েছেন তিনি।