গুলশান হামলায় নারীসহ চার সন্দেহভাজনের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.07.19
20160719-BD-Police1000.jpg রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৯ জনকে আটক করে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে সাতটি ককটেল, চারটি চাপাতি, বিপুল পরিমাণ বই ও কম্পিউটার উদ্ধার করা হয়। জুলাই ১৯, ২০১৬।
স্টার মেইল

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় অনেকখানি অগ্রগতি হওয়ার কথা জানিয়েছেন তদন্তকারীরা। তাঁরা বলছেন, তথ্য প্রমাণ ও আলামত থেকে এ ঘটনার রহস্য খুব শিগগির উদঘাটন করা যাবে।

ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে নারীসহ চার সন্দেহভাজনের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে র‍্যাব। গতকাল মঙ্গলবার র‍্যাব এই চারজনের ভিডিও ফুটেজ তাদের ফেসবুক পেইজে প্রকাশ করেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকেও গতকাল সাংবাদিকদের একই ধরনের ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়। এতে দেখা যায়, চারজনের মধ্যে তিনজন পুরুষ ও একজন নারী।

মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা বলেন, হলি আর্টিজানের ভেতর ও পাশ থেকে জব্দ করা পিস্তল, রাইফেল, এসবের গুলি, ছুরি, গাড়ি, মুঠোফোনসহ বিভিন্ন আলামত ইতিমধ্যে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে।

তিনি জানান, পাঁচ জঙ্গিসহ নিহত ব্যক্তিদের শরীর থেকে সংগৃহীত নমুনা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য শিগগিরই সিআইডির পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে।

তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, এ নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী, রেস্তোরাঁর কর্মীসহ অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মামলার অনেকখানি অগ্রগতি হয়েছে।

তাঁরা বলেন, বিভিন্ন ঘটনায় গ্রেপ্তার করা জঙ্গিদের কাছ থেকে ও বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে হামলার পেছনের ব্যক্তি ও মদদদাতাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, সব বাহিনীর সমন্বয়ে জঙ্গি হামলার ঘটনাগুলো তদন্তে ‘বিশেষ টিম’ হবে যাতে শেকড় পর্যন্ত ধরা যায়।

চারজনের ভিডিও ফুটেজ

ভিডিও ফুটেজে ওই চারজনকে গত ১ জুলাই রাতে হামলার সময় রেস্তোরাঁর পাশের ৭৯ সামনের সড়ক থেকে জব্দ করা ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়। সংক্ষিপ্ত ওই ভিডিও ফুটেজে চারজনকে ৭৯ নম্বর সড়কে কয়েকবার হাঁটাহাঁটি করতে দেখা যায় এবং মুঠোফোনে কথা বলতে থাকে তারা।

“তারা জঙ্গি হামলার ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে। কেউ শনাক্ত করতে পারলে আমরা তাদের ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি,” বেনারকে জানান র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান।

“১ জুলাই রাতে সন্দেহভাজন তিন যুবক ৮ টা ৪২ মিনিটে গুলশান ২-এর ৭৯ নম্বর সড়কে হাঁটাহাঁটি করছিল। এর আগে তাদের একজনকে সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কার থেকে নামতে দেখা যায় এবং সন্দেহভাজন নারীকে গাড়ি থেকে নামা যুবকটির সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়,” বেনারকে জানান মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের (সিটি) ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ওইদিন রাত ৮ টা ৪৭ মিনিটে হলি আর্টিজান থেকে প্রথম গ্রেনেড ছোড়ার সময় সন্দেহভাজন ওই তিন যুবক ৭৯ নম্বর সড়কেই ছিলেন। এরপর তারা চলে গেলেও সন্দেহভাজন নারী প্রায় সেখানে আধঘণ্টা অবস্থান করেন।

“ধারণা করা হচ্ছে তারা হামলাকারীদের সহযোগী। তাদের ও সাদা গাড়িটির মালিককে পাওয়া গেলে মামলাসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে,” জানান সাইফুল।

১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে ১৭ জন বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জিম্মির লাশ উদ্ধার করা হয়। অভিযানের আগে-পরে উদ্ধার করা হয় দেশি-বিদেশি ৩২ জনকে। ওই রাতে অভিযান চালাতে গিয়ে নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা রবিউল করিম ও সালাউদ্দিন খান। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোদের নেতৃত্বে সমন্বিত অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হয়।

নিখোঁজ ২৬ জনের তালিকা, দুই ছাত্র গ্রেপ্তার

আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী ২৬১ জনের একটি নিখোঁজ তালিকা তৈরি করেছে। দেশের বিভিন্ন থানায় স্বজনদের সাধারণ ডায়েরি একত্রিত করে ওই তালিকা তৈরি করা হয়। বুধবার এই তালিকা র‍্যাব–পুলিশের ওয়েবসাইটে প্রকাশ হতে পারে।

এদিকে জঙ্গি–সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গতকাল সিলেটের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লিডিং ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ। আটক ওই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শেষ সেমিস্টারের মাহমুদ চৌধুরী (২৬)।

এ ছাড়া সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকেও জঙ্গি–সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ঢাকার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি দল আটক করে গতকাল রাতেই ঢাকায় নিয়ে যায়।

শিবির নেতাসহ গ্রেপ্তার ১৯

রাজধানীর খিলগাঁও থানা ছাত্র শিবিরের সভাপতি মোতাহের হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকসহ ১৯ জনকে আটক করেছে পুলিশ। গতকাল সকালে খিলগাঁও এর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে সাতটি ককটেল, চারটি চাপাতি, বিপুল পরিমাণ বই ও কম্পিউটার উদ্ধার করা হয়।

আটক অন্যরা হলেন; মনিরুল ইসলাম, ইসমাইল হোসেন, কাউসার আহম্মেদ, আলাউদ্দিন খলিফা, রবিউল ইসলাম, ফয়সাল হোসেন, ইসমাইল, সুমন মিয়া, হাবিবুর রহমান, কামরুজ্জামানম, রাসেল রানা, সাইফুল্লাহ, আবসার আলী, মনিরুল ইসলাম, রুমান মোল্লা, শাহ আলম ও মনির হোসেন।

“আটকদের মধ্যে সবাই ছাত্র শিবিরের কমিটিতে আছেন কি-না তা তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে,” বেনারকে জানান খিলগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আসাদুজ্জামান।

জঙ্গিদের জামিন ঠেকাতে সেল

সন্দেহভাজন জঙ্গিদের জামিন ঠেকাতে একটি সমন্বয় সেল থাকা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেছেন, এই সেল রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখবে। পাশাপাশি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে মামলার এজাহার ও অভিযোগপত্রে যেন দুর্বলতা না থাকে, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে।

মঙ্গলবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে অ্যাটর্নি জেনারেল এসব কথা বলেন। জঙ্গিদের জামিন নিয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা চিহ্নিত জঙ্গি, তাদের নামসহ বিস্তারিত তথ্য কম্পিউটারে থাকা উচিত। প্রতিটি জেলার পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) যেন সেই কম্পিউটারে বোতাম টিপলেই নামগুলো পান।

অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়েও এমন ব্যবস্থা থাকা উচিত উল্লেখ করে মাহবুবে আলম বলেন, ‘জামিন ঠেকাতে সব জঙ্গির নাম-ঠিকানাসংবলিত একটি প্রযুক্তিগত অ্যাপলিকেশন দরকার। বোতাম টিপলেই যেন কোন জেলায় সন্ত্রাসী মামলায় কে কে আছে, তাদের কখন জামিন হয়েছে বা জামিনের আবেদন কবে করা হয়েছে—সেগুলো আমরা জানতে পারি।’

পুলিশ লাশ হস্তান্তর করতে চায়

জিম্মি ঘটনায় নিহত পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জনের লাশ ১৯ দিনেও তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত লাশগুলো সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) মর্গে ছিল।

নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা বলে আসছেন, তাঁরা লাশ নিতে এর আগে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু পুলিশ তাঁদের কিছুই বলছে না।

অবশ্য মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম গতকাল বলেন, “জঙ্গিসহ নিহত ছয়জনের পরিবারের কেউ লাশ নিতে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তাঁরা লাশ নিতে চাইলে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে লাশ হস্তান্তর করা হবে।”

“নিহত ছয়জনের লাশ আরও কিছুদিন মর্গে রাখা হবে। এ সময়ের মধ্যে স্বজনেরা লাশ না নিলে দাফনের জন্য আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হবে,” জানান ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

সতর্ক থাকার আহ্বান

দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাইকে সতর্ক ও সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “আমি কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দেব না। যা বলব ইশারা-ইঙ্গিতে বুঝে নেবেন। স্বাধীনতার পর স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। দ্বিতীয়বার যাতে ওই ধরনের ঘটনা ঘটতে না পারে, সে জন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।”

মঙ্গলবার রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় সৈয়দ আশরাফ এসব কথা বলেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।