গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া কাউকে আটক করতে পারবে না পুলিশ
2016.05.24

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করার যে ক্ষমতা পুলিশের ছিল তা বাতিল করে গতকাল মঙ্গলবার ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন উচ্চ আদালত।এ বিষয়টি ঘিরে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারের অসংখ্য নজির রয়েছে।
আপিল বিভাগ সাফ জানিয়ে দিলেন, আটকাদেশ দেওয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে না। এ ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। আর আটকের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে কারণ জানাতে হবে।
পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ—সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনা দিয়ে প্রায় ১৩ বছর আগে হাইকোর্ট এই রায় দিয়েছিলেন। ১৫ দফা নির্দেশনা সংবলিত ওই রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
হাইকোর্টের সেই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেছিল। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ গতকাল রায়ে বলেন, ৫৪ ও ১৬৭ ধারার কয়েকটি বিষয় সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
“সাদা পোষাকে কাউকে গ্রেপ্তার করতে হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দেওয়া উচিত। সাদা পোষাকে পরিচয় না দিয়ে পৃথিবীর কোথাও এভাবে গ্রেপ্তার করে না। আশা করি এটা বন্ধ হবে,” বেনারকে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
তবে তিনি বলেন, সব সময় আগে মামলা করে আসামি ধরা সম্ভব হয় না। অপেক্ষা করে বসে থাকলে তো সে পালাবে। যেমন যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু রাজাকার গ্রেপ্তারের নির্দেশ শুনে পালিয়েছে। আগে যদি তাকে ধরে ফেলতো পরে আদালতের সামনে নিয়ে আসত তাহলে পালাতে পারতো না। তবে এগুলো আবার জেনারালাইজ করা যাবে না। একেক ঘটনায় একেক রকম পদক্ষেপ নিতে হয়।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এই আইন কর্মকর্তা জানান, এখন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
মামলার শুরু একটি হত্যাকাণ্ড
প্রায় দেড় যুগ আগের একটি ঘটনায় করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল আপিল বিভাগ থেকে এই রায় এল। ১৯৯৮ সালে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ২৩ জুলাই মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশ-কার্যালয়ে তার মৃত্যু হয়।
ওই ঘটনার পর বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। তদন্ত শেষে কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করে।
সেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করে। তার চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাই কোর্ট এ বিষয়ে কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয়।
রাষ্ট্রপক্ষ ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন করলে ২০০৪ সালে তা মঞ্জুর হয়। দীর্ঘ সময় পার হওয়ার পর গতকাল রায় ঘোষণা হয়েছে। এ সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও রিট আবেদনকারীপক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন ও এম আমীর–উল ইসলাম।
হাই কোর্টের কিছু নির্দেশনা
হাইকোর্টের নির্দেশনায় বলা হয়, পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে না। কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাবে।বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেপ্তার ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে বিষয়টি জানাতে হবে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে তার পছন্দ অনুযায়ী আইনজীবী ও আত্মীয়দের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়, গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে কারাগারের ভেতরে কাচের তৈরি বিশেষ কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। ওই কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকট আত্মীয় থাকতে পারবেন। জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে।
এতে আরও বলা হয়, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবে। বোর্ড যদি বলে ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তাহলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা নেবেন এবং তাকে দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে।
আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল গতকাল পৃথকভাবে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
আনিসুল হক বলেছেন, ফৌজদারি কার্যবিধিতে ৫৪ ধারা ‘ইমার্জেন্সি প্রভিশন’ হিসাবেই রাখা হয়। এটা ভাল নাকি মন্দ, সেটা ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে। এই ধারার অপব্যবহার হয়েছে কি না—এ প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, অতীতে ‘সময়ে সময়ে’ হয়তো এটা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, “সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছেন, সেখানে আমাদের আর বলার কিছু নেই। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।”
মানবাধিকার কর্মীরা পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার এবং জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডের কড়া সমালোচনা করে আসছেন। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, আপিল বিভাগের এই রায় মানবাধিকারের পক্ষে ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশাবাদী।