নরসিংদীতে মন্দিরের তত্ত্বাবধায়কের ওপর হামলা,আইএসের দায় স্বীকার নিয়ে বিভ্রান্তি
2016.08.26

নরসিংদীর মাধবদীতে ব্যবসায়ী ও মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক চিত্তরঞ্জন আঢ্যর (৫৭) ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। হামলার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পরে গত বুধবার ইরাক-সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর মুখপত্র ‘আমাক’ সংবাদ সংস্থায় ঘটনার দায় স্বীকার করা হয়।
তবে স্থানীয় বিরোধের জের ধরে এই হামলা হয়েছে বলে মনে করছেন তাঁর পরিবার ও গ্রামের লোকজন। এমনকি আহত ব্যবসায়ী চিত্তরঞ্জনও মনে করেন, স্থানীয় বিরোধের কারণেই তিনি হামলার শিকার হয়েছেন।
স্থানীয় পুলিশের ধারণা, এটা জঙ্গি হামলা নয়। যদিও ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ইসলামী ছাত্র শিবিরের দুই নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে।
নরসিংদীর মাধবদী থানার ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সংলগ্ন রঘুনাথপুর গ্রামে চিত্তরঞ্জনের বাসা। বাসার পাশেই তাঁর দোকান, দোকানের পাশে একটি কালী মন্দির। মন্দিরের দেখভাল করতেন তিনি। গত মঙ্গলবার রাতে দোকানে বসে থাকা অবস্থায় তাঁর ওপরে হামলা হয়।
একটি মোটরসাইকেলে আসা তিন যুবকের মধ্যে একজন চিত্তরঞ্জনকে দোকানের ভেতরে ঢুকে চাপাতি দিয়ে কোপায়। এ ঘটনায় আমাকের এক বার্তা টুইট করে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক রিটা কাৎজ।
ওই বার্তায় বলা হয়, বাংলাদেশের নরসিংদী জেলায় আইএসের যোদ্ধারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে এক হিন্দু পুরোহিতকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। হামলার পরে বিষয়টি নিয়ে হই চই না হলেও আইএসের দায় স্বীকারের পরে চারদিকে তোলপাড় শুরু হয়।
হামলার খবরটি দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রথমদিন ভেতরের পাতায় ছাপা হলেও আইএসের দায় স্বীকারের পরে এ বিষয়ে প্রথম ও শেষ পাতায় প্রকাশিত হয়।
মাথায়, ঘাড়ে, গলায়, পেটে ও হাতের কবজিতে জখম নিয়ে চিত্তরঞ্জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সেখান থেকে স্বাক্ষর করে লিখিত অভিযোগ পাঠিয়ে গত বুধবার রাতে মাধবদী থানায় তাঁকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে একটি মামলা করেছেন চিত্তরঞ্জন।
মামলায় তিনি চার সন্দেহভাজনের নাম উল্লেখ করেছেন। এদের মধ্যে মো. ফিরোজ নামে এক গাড়ি চালককে আটক করে পুলিশ।
এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, গত মঙ্গলবার রাতে তিনি দোকানে বসে মো. হাবিব নামে একজনের সঙ্গে ব্যবসায়িক বিষয় নিয়ে আলাপ করছিলেন। এসময় একটি মোটরসাইকেলে তিনজন এসে দোকানের সামনের মহাসড়কে থামে। দুজন নেমে এসে একজন হাবিবের বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে চুপ থাকতে বলে।
আরেকজন দোকানের ভেতরে ঢুকে চাপাতি দিয়ে চিত্তরঞ্জনের মাথায়, ঘাড়ে, গলায়, পেটে এলোপাতাড়ি কোপায়। হামলা ঠেকাতে গিয়ে ডান হাতের কব্জিতেও আঘাত লাগে। তাঁর চিৎকারে বাড়ির লোকজন ছুটে এলে হামলাকারীরা চাপাতি ফেলে মোটরসাইকেলে উঠে মাধবদীর দিকে চলে যায়। হামলাকারীদের মুখ ঢাকা ছিল।
এজাহারের উল্লেখ করা হয়, মুদি দোকানের পাশাপাশি লেগুনা গাড়ির ব্যবসা রয়েছে তাঁর। গত বছরের ২৮ আগস্ট তাঁর একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় পরে কবির মিয়া নামে এক গাড়ি চালক নিহত হন।কবীরের স্ত্রী ও তিন বছরের একটি ছেলে রয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে কবীরের পরিবারটিকে নানাভাবে সাহায্য করতেন তিনি।
কবীরের স্ত্রী নাহিদা বেগম ওরফে নাইচ খানের সঙ্গে তাঁদের পারিবারিক সখ্য গড়ে ওঠে। এই সখ্যতাকে কেন্দ্র করে নিহত কবীরের ভাই সুমন মিয়া, রিপন মিয়া, বোন কোহিনূর বেগম, ভগ্নিপতি ফিরোজ ও স্থানীয় মো. আপেলের সঙ্গে তাঁর শত্রুতা তৈরি হয়।
এরা বিভিন্ন সময় চিত্তরঞ্জনকে মারধর ও মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আসছিল। এমনকি কয়েকদিন আগে তাঁরা চিত্তরঞ্জনকে অপহরণেরও চেষ্টা করে।
চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী চঞ্চলা আঢ্য বেনারকে বলেন, “নিহত কবীরের স্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। কবীরের স্ত্রী নাইচ খান তাঁদের কাকা-কাকী বলে সম্বোধন করেন। বিভিন্ন সময় তাঁরা পরিবারটিকে নানাভাবে সাহায্য করে আসছেন। কিন্তু কবীরের ভাই-বোনেরা বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি।
গাড়ি চালক কবীরের স্ত্রী নাইচ খান বেনারকে বলেন, চিত্তরঞ্জনের পরিবারের সঙ্গে সখ্য নিয়ে তাঁর দেবর ও ননদেরা তাঁকে সন্দেহ করতো। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময় তাঁরা নাইস খানকে মারধরও করেছে। এক পর্যায়ে গত ১৫ আগস্ট পাঁচদোনা পুলিশ ফাঁড়িতে বিষয়টি নিয়ে লিখিত অভিযোগ করেন তিনি। অভিযোগ পেয়ে পুলিশ বাড়িতে এলে স্থানীয় গণ্যমান্যরা পুলিশের উপস্থিতিতে বিষয়টি মীমাংসা করে দেওয়ার আশ্বাস দেয়। পুলিশ অভিযোগের কাগজটি নিয়ে চলে যায়, তবে কোনো মামলা দায়ের হয়নি। পারিবারিক সালিশে মীমাংসার পর আর কোনো ঝামেলা হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইকবাল বেনারকে বলেন, “তিলরে তাল বানাইতাছে। এইডা লোকাল ঝামেলা। সবাই জানে দুই পরিবারের বিরোধ আছে। চিত্তরঞ্জন বাবু তো নিজেই বিষয়টা জানেন।”
এ ঘটনায় চিত্তরঞ্জনের দায়ের করা হত্যা প্রচেষ্টা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মাধবদী থানার উপপরিদর্শক তানভীর আহাম্মদ মনে করেন, আতঙ্ক তৈরির জন্যই আইএস এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। তবে সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বেনারকে তানভীর জানান, “গ্রেপ্তার হওয়া ফিরোজকে জিজ্ঞাসাবাদে সে চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে তাঁর পরিবারের লোকজনের বিরোধের বিষয়টি স্বীকার করেছে। তবে হামলার বিষয়য়ে কিছু জানে না বলে দাবি করেছে।”