আইএসের হাত থেকে সন্তানকে উদ্ধারের চেষ্টায় বাবা ঝুঁকি নিলেন

রাজলান রশীদ
2016.03.08
IS-story সন্তানের খোঁজে বাবা। আলেপ্পোর কাছে গাড়ি নস্ট হয়ে গেলে সাহায্য করছিলো অন্যরা। ডিসেম্বর,২০১৩
বেনার নিউজের বিশেষ ফটো

সে ছিলো সুবোধ বালক এবং প্রতিশ্রুতিশীল ভবিষ্যতের জন্য আদর্শবাদী। কিন্তু সব কিছু বদলে যায় তার ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবরে।

সেই রাতে ২২ বছর বয়সের আয়ারল্যান্ডে অধ্যায়নরত মেডিক্যাল ছাত্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশে তার বাবা-মাকে ফোন করে জানালো যে সে সিরিয়ায় চলে গেছে।

তার বাবার ভাষায় “সে আরব সুন্নি মুসলিম সন্ত্রাসীদের ফাঁদে পড়ে”।

কিছুদিনের মধ্যে বাবা তার সন্তানের খোঁজে রওনা হয়ে পৌছে যায় ইসলামিক স্টেটের অধিকৃত সিরিয়ার ভুখন্ডে কিন্তু তা শেষ হয় অবশেষে হৃদয় বিদারক বিয়োগান্তে।

বাবা বেনার নিউজের সঙ্গে কথা বলছিলেন তাদের পরিবারের কারো নাম না প্রকাশ করার শর্তে। নিরাপত্তার স্বার্থে পরিবারের অন্যান্য খুটিনাটি তথ্যও তিনি আড়াল করেন। এই ভয়ে যে তাদের কোনো তথ্য প্রকাশ হলে পরিবারের সদস্যরা সমস্যায় পড়বে এবং তাদের কাজকর্মে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

তবু তিনি তার কাহিনী শেয়ার করতে চান যাতে অন্যরা এই ট্রাজেডির অভিজ্ঞতা জানতে পারেন এবং এ থেকে তারা কিছু শিক্ষা নিতে পারেন।
বেনার নিউজের প্রতিনিধি প্রথম এই বাবার সঙ্গে দেখা করেন তুরস্কে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে।


‘মগজ ধোলাই’

তরুন ছেলেটি আয়ারল্যান্ডে ডাক্তারি পড়ছিলো। সেখানে থাকতেই সে বাবা-মা কে মধ্যপ্রাচ্যে ভ্রমনের ইচ্ছার কথা জানায়। সে চাইছিলো সেখানে যুদ্ধের কারণে শোচনীয় অবস্থায় পড়া মানুষদের সাহায্যে কাজ করবে। তার বাবা জানায় সে কথা।

বেনার নিউজকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাতকারে তিনি জানান, “আমি ছেলেকে উপদেশ দেই যেহেতু সে মেডিসিনের উপর পড়াশুনা করছে, সবচেয়ে ভালো হবে সে যদি একটা ক্লিনিক বা হাসপাতাল খোলে তাহলে ঐসব লোকদের ভাল সাহায্য করতে পারবে এবং তাকে প্রতিশ্রুতি দেই যে তাকে সেজন্য তহবিল যোগার করে দেবো”।

“আমার একমাত্র শর্ত ছিলো সে তার মানবিক কাজ শুরু করতে পারবে তার গ্রাজুয়েশনের পর”।

কয়েকদিন যাবত ছেলের কাছ থেকে কোনো কথাই শুনতে পাচ্ছিলো না। এরপরই সিরিয়া থেকে কল আসে। একঘন্টার মধ্যে বাবা তার দেশের পুলিশকে জানায়।

এরপর সে অনলাইনে গবেষণা চালাতে শুরু করে কিভাবে আইএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটা ছেলেকে বিশ্বের আর এক প্রান্ত থেকে টেনে নিয়ে গেলো।

২০১৩ সালের অক্টোবরে তখনো আইএস পরিচিত কোনো নাম হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ছেলের ফোন কলে বাবার মনে সন্দেহ দেখা দেয়, ছেলে হয়তো সন্ত্রাসীদের ফাঁদে আটকা পড়েছে।

কয়েকটি ফোন কলের পর, সে বুঝতে পারে ছেলের মধ্যে কিছু একটা পরিবর্তন ও ক্রমাগত দুরত্ব বেড়ে যাওয়া।

“সে গোপন করে যাচ্ছিলো তার সঠিক অবস্থান কোথায় ও তার পরিকল্পনা কি। আমি পরিস্কার বুঝতে পারলাম যখন তার সঙ্গে কথা বলার সময় যে তাকে মগজ ধোলাই করা হয়েছে। তবু সে নরম সুরেই কথা বলে গেছে”। জানায় বাবা।

বাবা দিনরাত ইন্টারনেট ঘেটে পড়াশুনা করে জানতে পারেন, সিরিয়ায় সংঘাত চলছে, বিদ্রোহী গ্রুপ বাশার আল আসাদের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।

“আমি সোশাল মিডিয়াগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করি। আইএস এবং বিদ্রোহী গ্রুপগুলো লোকজন সংগ্রহ করছিলো। আমি হোহাটস-আপ, টেলিগ্রাম, উইচ্যাট, ফেসবুক সহ সব মাধ্যম ব্যবহার করা শুরু করি। এইসব ছিলো আমার অপরিচিত জায়গা”। জানান তিনি।

ইন্টারনেটের মাধ্যমে তিনি সিরিয়া ও তুরস্কের কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেন, যাতে তারা তার ছেলের অবস্থানের খোঁজ দিতে পারে এবং তাকে অনুসরণ করতে পারে।

২০১৩ সালের নবেম্বরে তার ছেলে আর একটি কলে জানায় সে আইএসে যোগ দিয়েছে কিন্তু কোথায় আছে সেটা বলতে চায় নাই।

তিনি আরো জানান, “সে তার নেতার (আমির) উপদেশ মোতাবেক তার অবস্থান প্রকাশ করছিলো না, এমনকি বাবা-মাকেও না। তখনি বুঝতে পারলাম তাকে শুধু মগজ ধোলাই করা হয় নাই। ফোনে কথা বলার সময় আরব সন্ত্রাসীরা তাকে নজরদারিতে রাখছে”।


যুদ্ধক্ষেত্রে

কিছুদিনের মধ্যেই বাবা রওনা হয়ে গেলো তুরস্ক হয়ে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে। এটা ছিলো সংঘাতপুর্ন এলাকায় প্রবেশের পথ।
তুরস্কের হাতায় প্রদেশের সীমান্ত শহর রেয়হানলি হয়ে তিনি সরাসরি সিরিয়ায় ঢুকে পড়লেন।

সেখানে ঢোকার আগে তিনি সেই সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন যারা সেখানে সিরিয়ার অভ্যন্তরের বিদ্রোহীদের জন্য ওষুধ,খাদ্য ও অন্যান্য সাহায্য সামগ্রী সরবরাহ করে থাকেন। তাদের একজন তাকে তাদের সঙ্গে নিতে রাজি হলেন।

“আমি সেখানে বাদলহাওয়ায় অবস্থান নিলাম, যেটি সীমান্ত থেকে বেশি দূরে ছিলো না এবং সিরিয়ায় সবচেয়ে নিরাপদ স্থান বলে জানতে পারলাম”। তিনি জানালেন।

 ছেলেটি ইউরোপে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলো তখনই সে সন্ত্রাসীদের ফাঁদে পা দেয়।

 

যে তাকে সঙ্গে নিয়েছিলো তার হাতেও অস্ত্র ছিলো। “আমি জানতাম আমি ভালো মানুষ, তবে যে কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে”।

যখন তিনি প্রথম একটি গ্রুপের সঙ্গে দেখা করলেন, তাদেরকে তিনি ৪০ হাজার মার্কিন ডলার তুলে দিলেন তার ছেলেকে খুঁজে বের করার খরচ হিসেবে। কিন্তু তারা পরে টাকাগুলো ফেরত দিলেন। পিতা জিজ্ঞাশ করলেন তাদেরকে, কেনো তারা টাকা ফেরত দিচ্ছে।

“আমি তাদের কাছে এ যাবত কালের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর কথা শুনতে পেলাম। তারা বললো, আপনি একজন মুসলিম আমরাও মুসলিম। আপনার ছেলেকে খুঁজে বের করা আমাদের দায়িত্ব এবং এটাই আমাদের ইসলাম”।


‘খারাপের জন্য প্রস্তুতি’

সব মিলিয়ে বাবা ঐ অঞ্চলে ৫ সপ্তাহ অতিবাহিত করলেন। বেশির ভাগ সময় তুরস্কের দিকে সীমান্তের ওপারে।

সিরিয়ার ভেতরের সময়গুলিতে যাদের সঙ্গে গিয়েছেন তারা তাকে ‘একজন স্বেচ্ছাসবী ডাক্তার’ হিসেবে পরিচয় দেয়। সিরিয়ায় তিনি মাত্র এক সপ্তাহ ছিলেন। কিন্তু বিপদজ্জনক অবস্থা দূরে ছিলো না।

একদিন আলেপ্পোতে গাড়িতে ভ্রমনের সময় ১০ মিটার দূরে বিমান থেকে বোমা ফেলা হয়। অল্পের জন্য বেঁচে যান। আরেক সময় সরকার পক্ষের আক্রমন থেকেও সামান্যের জন্য বেঁচে যান।

আলেপ্পো এবং বাদলহাওয়ার মধ্যবর্তি স্থানে তাদের গাড়িটি নস্ট হয়ে যায়। তিনি ও তার সাথে একজন পায়ে হেটে নিকটবর্তি একটি গ্রামে মেকানিকের সন্ধানে বের হন। সেখানকার গোলাগুলিতে বিধ্বস্ত গ্রামের অধিবাসী তাদেরকে খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করে। একজন মিস্ত্রিও খুঁজে দেয়। কিন্তু অনেক সময় নিয়ে সে গাড়িটি মেরামত করে।

“আমরা খাবার খেলাম এবং নামাজ পড়ে কফি পান করছিলাম। এমন সময় একজন গ্রামবাসী বাশার বাহিনীর উদ্দেশ্যে গালাগালি শুরু করে দিলো। বাশার বাহিনী ৫০০ মিটার দূরে ছিলো”। বলে যাচ্ছিলেন তিনি।

“বাশার বাহিনী এগিয়ে আসছিলো, গ্রামের যোদ্ধারা যুদ্ধ করার জন্য তৈরি হলো। তারা আমাকেও একটা অস্ত্র দিতে চাইলো। আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমি বন্দুক চালাতে জানি না। আমি মারাত্নক অবস্থার জন্য তৈরি হলাম”।

মিস্ত্রি গাড়ি ঠিক করার পর আমরা যুদ্ধাবস্থা থেকে সময় মতো বেরিয়ে আসতে পারলাম।


‘কতো কাছে, তবু কত দূরে’

সংঘাতকালীন সময়ের এক সপ্তাহে বাবা বিভিন্ন গ্রুপের কাছ থেকে ছেলে সম্পর্কে তথ্য নেয়ার চেষ্টা করলেন।

“সব গ্রুপের লোকরাই আমাকে বুঝতে পারলেন এবং প্রতিশ্রুতি দিলেন তার ছেলেকে তাদের মধ্যে কোথোও থেকে থাকলে খুঁজে এনে দেবে। কিন্তু সতর্ক করলেন, এটা হবে খুব কঠিন ব্যাপার যদি তার ছেলে আইএসের কোনো ক্যাম্পে থেকে থাকে”।

এরপর তিনি অন্য একটি আইএস ক্যাম্পের দিকে গেলেন। তিনি নিজের একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে অর্থের বিনিময়ে তথ্য প্রদানকারী নিয়োগ করলেন যাতে তার সন্তানের অবস্থানের খোঁজ দিতে পারে।

তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী জানতে পারলাম, তার ছেলে দার তা ইজ্জাহ-এর আইএস ক্যাম্পে আছে যেখানে ইউরোপের যোদ্ধারা আছেন। “আমি স্থানীয় লোকজনদের সহায়তায় সব মিলে ৭টি আইএস ক্যাম্প-এ খোঁজ নেই”।

“আমি মনে করতে পারি দার তা ইজ্জাহতে আইএসের ইউরোপিয়ানদের ক্যাম্পের কাছে গেলে তারা আমাকে গাড়ির ভিতরেই থাকতে বলে, তাদের অস্ত্রগুলোও গাড়িতেই রেখে যায়”। কিন্তু ক্যাম্পের নেতারা জানাতে অস্বীকার করে তার ছেলে সেখানে আছে কিনা। বলে, তাদের এইসব তথ্য দেয়ার অনুমতি নাই।

“দেখে মনে হলো, ক্যাম্পের চারদিকের বর্ননা আমার ছেলের সাথে কথা বলার সময় সে যেমন ধারনা দিয়েছিলো সে রকমই। আমার মন বলছিলো এটাই সেই ক্যাম্প”।

“এমনকি আমাদের সাথের নেতা আমাকে ক্যাম্প দেখে এসে ব্যক্ত করলো তার ছেলে এই ক্যাম্পেই আছে। এতো কাছে তবু কত দূরে”, কান্না জড়িত কন্ঠে বাবা সে কথা জানালো।

 

 ছেলেটি ইউরোপে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলো তখনই সে সন্ত্রাসীদের ফাঁদে পা দেয়।

 

 

নীরবতা

সন্তানের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময়গুলোতে বাবা জানায় নাই সে কোথায়। কিন্তু একদিন বাবা তার ছেলের কাছে স্বীকার করেছিলো যে সে তার খোঁজে সিরিয়ায় গিয়েছিলো।

ঘটনাক্রমে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তাদের মধ্যে কথা বলা কমে গিয়েছিলো।

ছেলেকে চোখে দেখতে না পেরে তার খোঁজ-খবর নেয়া বাদ দিয়ে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বাড়ি ফিরে আসে বাবা।

গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বাবা পরে জানতে পারে তার ছেলের আইএস ইউনিটটিকে ইরাকে পাঠানো হয়।

“ফোন যখন কমে আসে আমি জানতে পারি তার হাতের ফোনটি তার আমির সরিয়ে নিয়েছে”।

সেই বছর আগস্টে রমজানের ৫ দিন আগে তার একজন তথ্যদাতা জানায়, ৪ মাস আগে তার ছেলে ইরাকের মসুলে বন্ধুক যুদ্ধে মারা গেছে।
এই তথ্য প্রদানকারী একজন আইএস সদস্যের স্ত্রী, তিনি বাবাকে জানান, জঙ্গি গ্রুপটি তার ছেলেকে রিক্রুট করেছিলো সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করার জন্য।

“আমি জানি আমাকে যে তথ্য দেয়া হয়েছে তা সঠিক কারণ এপ্রিল থেকে আজ পর্যন্ত আর কোনো যোগাযোগ বা ফোন কল ছিলোনা। এই মহিলা জানায়, আমি এই তথ্য অনেকদিন থেকে ধরে রেখেছি কারণ আমি নিজেকে তার জন্য অপরাধী মনে করছিলাম”, জানায় বাবা।

কোনো দেশের মৃত্যুর তালিকায় তার ছেলের কোনো নাম নেই। সিরিয়ায় কিংবা ইরাকে যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে। বেনার নিউজের পক্ষ থেকে ইরাক সরকারের কাছে খোঁজ নেয়া হলে তারা ঐ ছেলের মৃত্যুর কোনো খবর নিশ্চিত করতে পারে নাই।

এই বাবা জানে না যে, অন্য পরিবারের ছেলেরা যারা ইরাক কিংবা সিরিয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে তাদের খবর অফিসিয়ালি কখনোই নিশ্চিত করা হয় না।

“এটা ছিলো এক শোচনীয় অবস্থা, সে ছিলো আমার সব প্রেরনার উৎস, তারপর এই ঘটলো। আপনি বুঝতে পারবেন না এটা আমাদের সবার জন্য কি রকম ঘটনা” কাঁদতে কাঁদতে জানালেন তিনি।

২০১৪ সালের ঈদে বাবা তার পরিবার সহ নিজ এলাকায় বিদেহি সন্তানের জন্য প্রার্থনা সভার আয়োজন করেন।


মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।