কলকাতায় শীত উধাও, কিন্তু আনন্দ জমজমাট

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2016.01.06
Ind-heat কলকাতায় শীতের দেখা নেই, গরমে অনেকেই গঙ্গায় নেমে শীতল হয়ে নিচ্ছে।
অনলাইন

বড়দিন চলে গেল। চলে গেল ইংরেজি নববর্ষও। কলকাতায় শীতের দেখা মিলল না।

বড়দিনে কলকাতার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৮.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, স্বাভাবিকের থেকে ৪ ডিগ্রি বেশি। গত এক দশকের বড়দিনের নিরিখে এটাই সব থেকে বেশি।

আলিপুর আবহাওয়া অফিস বলছে, উত্তুরে হাওয়ার ঘাটতি এবং বাতাসে বাড়তি জলীয় বাষ্পই শীতকে সরিয়ে নিয়েছে গিয়েছে। শনিবার কলকাতায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৫.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা কি না এ সময়ের স্বাভাবিকের থেকে ৩ ডিগ্রি বেশি। আবহবিদেরা বলছেন, আগামী ক’টা দিন শীতের কাছ থেকে এর বেশি কিছু আশা না করাই ভাল।

অবশ্য, শুধু কলকাতাই নয়, গোটা দেশেই অস্বাভাবিক গরম চলছে। জম্মু ও কাশ্মীর, এবং তার পার্শ্ববর্তী কিছু এলাকা বাদে এই শীতে গোটা দেশেই তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে চার থেকে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। আবহওয়াবিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা এল নিনোর প্রভাব।

ভূমধ্যরেখা-সংলগ্ন অঞ্চলে প্রশান্ত মহাসাগরের জলতলের উষ্ণতার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির নামই এল নিনো। গোটা দুনিয়ার আবহাওয়াতেই তার প্রভাব পড়ে। ভারতের আবহাওয়ার ওপর এল নিনোর প্রভাব স্পষ্ট। পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের অধ্যাপিকা পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘এ বার প্রশান্ত মহাসাগরে জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা এল নিনো-র প্রভাব বঙ্গোপসাগরের উপরে পড়েছে। তার জেরে শীতকালে ঘন ঘন ঘূর্ণাবর্ত-নিম্নচাপ তৈরি হচ্ছে। দক্ষিণবঙ্গের বাতাসে জলীয় বাষ্প ঢুকে মেঘ তৈরি করছে। উত্তুরে হাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন বাংলাদেশের ঘূর্ণাবর্তের জন্য গত কয়েক দিন ধরে জলীয় বাষ্প ঢুকছে দক্ষিণবঙ্গে।’

আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে ঢোকা জলীয় বাষ্পকে ঠেলে সরাবে, এমন জোরালো উত্তুরে হাওয়ার দেখা নেই। তাঁর ব্যাখ্যা, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে কনকনে ঠান্ডা পড়লে বা শৈত্যপ্রবাহ চললে সেখান থেকে বয়ে আসা কনকনে হাওয়া এ রাজ্যে শীতের দাপট বাড়ায়। কিন্তু গত কয়েক দিন উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে শৈত্যপ্রবাহ তো দূর,  রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের নীচেই নামছে না।

শুধু কলকাতা নয়, পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্রই ঠাণ্ডার পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কম। আবহাওয়ার এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবনযাত্রাতেও। পশ্চিমবঙ্গের আবগারি দফতর যেমন জানিয়েছে, এই বছর বিলিতি মদ বিক্রির বৃদ্ধির হার গত বছরের তুলনায় ঢের কম।

বিজ্ঞাপন জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব রংগন চক্রবর্তী মজার সুরে বললেন, ‘ঠাণ্ডা না পড়লে কি আর শরীর গরম রাখার দরকার পড়ে? খোঁজ করে দেখুন, মানুষ এই শীতেও হয়তো ডাবের জল খাচ্ছে!’ চাঁদনি চক অঞ্চলের ডাব বিক্রেতা ইসমাইল অবশ্য বললেন, অন্য বছরের মতোই এ বছরও শীতে ডাবের বিক্রি কমই রয়েছে।

তবে, প্রভাব পড়েছে অন্য ব্যবসায়। প্রতি বছর শীতে কলকাতার ওয়েলিংটন অঞ্চলে শীতবস্ত্রের পসরা সাজিয়ে বসেন ভুটিয়া বিক্রেতারা। এ বছরও তাঁদের দোকান বসেছে, কিন্তু ক্রেতার সংখ্যা অনেক কম। আফসোস করছিলেন প্রীতি খোরপে নামের এক মধ্যবয়স্কা বিক্রেতা। বললেন, ‘শীতই পড়ল না, মানুষ গরম জামা কিনতে আসবে কেন?’  তাঁর দোকান থেকে কয়েকটা সোয়েটার দেখে শেষ পর্যন্ত না কিনেই চলে গেলেন এক মহিলা। নিজের নাম প্রকাশ না করেই বলললেন, ধুর, এ বছর আর শীতের কাপড় কিনে কী লাভ?

শীত না থাকলেও এই ঋতুর আকর্ষণগুলো অবশ্য রয়েছে। কলকাতা চিড়িয়াখানায় রেকর্ড ভাঙা ভিড় হল বছরের প্রথম রবিবার। প্রায় এক লক্ষ লোক হাজির হলেন আলিপুরে ভারতের সবচেয়ে পুরনো চিড়িয়াখানায়। টালা পার্ক ময়দানে অজন্তা সার্কাসের তাবুর সামনেও উদগ্রীব কচিকাচা এবং তাদের মা-বাবার ভিড়। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা ময়দানেও উপচে পড়েছে মানুষের ঢল। ভিড় জমেছে কলকাতার হরেক প্রান্তে চলা বিভিন্ন মেলাতেও।

তেমনই এক মেলা থেকে হাসিমুখে বাড়ি ফিরছিলেন সত্তরোর্ধ্ব নাট্য ব্যক্তিত্ব রূপক সেনগুপ্ত। গায়ে শাল, গলায় মাফলার। বললেন, শীত পড়ুক আর না-ই পড়ুক, শীতের আনন্দও আছে, মাফলার-চাদরও আছে। ক্যালেন্ডারে জানুয়ারি মাস চলছে যে!

যে শীত লুকোচুরি খেলছে মহানগরের সঙ্গে, তাকে নিয়েই শহরের আহ্লাদের অন্ত নেই। অল্প দিনের অতিথি যে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।