ভারতে সীমান্ত বিল পাশ, ছিটমহল বিনিময়ে বাংলাদেশের বাঁধা দূর হলো

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.05.06
Ind-landbill ভারতের রাজ্যসভায় স্থল সীমান্ত বিষয়ক বিলটি পাসের খবরে বুধবার কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার অভ্যন্তরের ভারতীয় ছিটমহল ১৫০ নম্বর দাসিয়ার ছড়ায় আনন্দ মিছিল করে স্থানীয়রা। চুক্তিটি বাস্তবায়ন হলে এ ছিটমহলটি বাংলাদেশের সীমানায় আসবে। ৬ মে,২০১৫
বেনার নিউজ

বাংলাদেশের কাছে বহু প্রতীক্ষিত সীমান্ত বিল পাস হয়েছে ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভায়। যার মাধ্যমে ছিটমহল বিনিময়ের প্রধান বাধা দূর হল বলে মনে করছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এবার বদলাবে দেশের মানচিত্রও।

নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভায় মঙ্গলবার অনুমোদিত বিলটি বুধবার রাজ্যসভায় সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে ভূমি বিনিময়ে ভারতের সংবিধান সংশোধনের এই বিলটির পক্ষে মত দেয় রাজ্য সভার ১৮০ জন সদস্যই।

রাজ্যসভায় পাস হওয়া বিলটি দ্রুতই বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকসভায় বিলটি পাস হবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ। আর এর ফলে দুই দেশের ১৬২টি ছিটমহলের বাসিন্দাদের দূর্ভোগ শেষ হবে।

রাজ্যসভায় বিলটি পাস হওয়ায় ভারত সরকার ও পার্লামেন্ট সদস্যদের অভিনন্দন জানিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘এর ফলে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা দূর হল। আশা করিছ বাকি প্রক্রিয়াও দ্রুততম সময়ে শেষ হবে।’

বেনারের কাছে প্রকাশ করা প্রতিক্রিয়ায় তিনি আরো বলেন, এবার দুই দেশের ভূখন্ডের মালিকানার বিরোধ নিষ্পত্তির পাশাপাশি ছিটমহলবাসীদের নাগরিকত্ব সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে। বিলটি ভারতীয় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে পাসের পর প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে দ্রুততার সাথে ছিটমহলবাসীরা যাতে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পান তা নিশ্চিত করা হবে।

বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোতে জনসংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার এবং ভারতীয় ছিটমহলগুলোতে প্রায় ৩৭ হাজার জনসংখ্যা রয়েছে।

বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়ে বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, ‘এর মধ্য দিয়ে দুই নিকট প্রতিবেশীর দীর্ঘ চার দশকের অমীমাংসিত সীমান্ত সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হতে যাচ্ছে।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মহিউদ্দিন আহমেদ এক প্রতিক্রিয়ায় বেনারকে বলেন, “ভারতের রাজ্য সভায় বিলটি পাশ হওয়ার মধ্য দিয়ে ছিটমহল বিনিময়ের পথ প্রশস্ত হল।  বিষয়টি অত্যন্ত আনন্দের”।

তবে প্রতিবেশি ভারত বলেই বোধ হয় আশার পাশাপাশি কিছুটা শঙ্কাও দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, চুক্তিটি বাস্তবায়নে এখনো কয়েকটি ধাপ বাকি আছে। তাই শঙ্কা কিছুটা থেকেই যায়। চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়েও চুক্তি স্বাক্ষর না করার উদাহরণ ভারত দিয়েছে তিস্তার চুক্তির বিষয়ে।

এ বিষয়ে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন,“ সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পরেও ২০১১ সালে  ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ঢাকা সফরে আসেন নি পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। ফলে ভেস্তে গিয়েছিল তিস্তা চুক্তি। তবে এবার তেমনটি হবে না বলেই আশা করি। আমাদের প্রত্যাশা শীঘ্রই ভারতের লোকসভাতেও বিলটি পাস হবে। এবং বাকি আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে মোদীর সফরে”।

কূটনৈতিক সূত্রের খবর, সীমান্ত চুক্তি সমাধানের পরেই ঢাকা সফরে আসছেন মোদী। সেটা হতে পারে এ বছরের জুনেই। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও জানিয়েছেন ভারতীয় প্রধান মন্ত্রীর সফর নিয়ে দুদেশের মধ্যে আলোচনা চলছে।

নানা টালবাহানা শেষে সীমান্ত বিল মঙ্গলবার রাজ্যসভায় উঠে। আসামকে বাদ দিয়েই সীমান্ত বিলটি পাস করাতে মরিয়া হয়েছিল বিজেপি। কিন্তু কংগ্রেসের জোরালো আপত্তি তোলে, যারা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এই বিল পার্লামেন্টে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর পিছু হটে বিজেপি। মঙ্গলবার অপরিবর্তিতভাবে বিলটিতে সমর্থন দেয় ভারতের মন্ত্রীসভা।

ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি নামে পরিচিত ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা সফরে এসে প্রটোকলে স্বাক্ষর করেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং।

বাংলাদেশ ওই চুক্তিতে অনুসমর্থন দিলেও জমি হস্তান্তরে ভারতের সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হওয়ায় বিষয়টি আটকে থাকে। ভারতের বিগত কংগ্রেস সরকার কয়েক দফা উদ্যোগ নিয়েও বিজেপি ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতায় রাজ্যসভা ও লোকসভায় তা পাস করাতে ব্যর্থ হয়।

এরপর ২০১৪ সালের ক্ষমতায় বসে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের অংশ হিসাবে ৬৫ বছর ধরে ঝুলে থাকা সমস্যাটি সমাধানের উদ্যোগ নেয় বিজেপি।  নানা চাপের মধ্যে শেষ পর্যন্ত সম্মতি দেন শুরু থেকে আপত্তি করে আসা পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতাও।

তিনি জানান, তৃণমূল সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তির সমর্থন দিয়েছে। কারণ, মানুষ এটা চায়। তবে সীমান্তবর্তী এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের পুনর্বাসনের জন্য কেন্দ্রের কাছ থেকে সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।

পুনর্বাসন প্যাকেজের বিষয়ে মমতা বলেন, ‘আমাদের ১৭ হাজার একর জমির বিষয় এ চুক্তির সঙ্গে জড়িত। আমাদের রাজ্যে আসা বাড়তি ৬০ থেকে ৭০ হাজার মানুষের থাকা-খাওয়া, ভবন নির্মাণ, সড়ক নির্মাণ, স্কুল ইত্যাদির জন্য একটি প্যাকেজ কর্মসূচির কথা কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়েছি। এসব মানুষের সমস্যা আমাদের দেখতে হবে। এটি একটি মানবিক সমস্যা।’

এদিকে সংসদীয় মন্ত্রী ভেঙ্কাইয়া নাইডু জানিয়েছেন, ‘রাজ্যসভায় বিলটি পাস করিয়ে বুধবার রাতেই রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের চেষ্টা চলছে। পরদিন (বৃহস্পতিবার) বিলটি লোকসভায় পেশ করা হবে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আর বিলম্ব না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার।


বদলাবে মানচিত্র

সংশ্রিষ্টরা বলছেন, প্রটোকল বাস্তবায়িত হলে দুই দেশের মানচিত্রই পাল্টে যাবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রাপ্য ছিটমহল বেশি হওয়ায় নতুন মানচিত্রে দেশের আয়তন কিছুটা বাড়বে।

এ বিষয়ে গতবছর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত এক পুস্তিকায় বলা হয়, ২০১১ সালের প্রটোকলে সীমান্তে অচিহ্নিত অংশগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল এবং অপদখলীয় ভূমি সমস্যার সমাধান করে স্থায়ী সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে। এর আওতায় বাংলাদেশের ভেতর থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল (১৭ হাজার ১৬০.৬৩ একর) বাংলাদেশকে দেবে ভারত। অন্যদিকে ভারতের মধ্যে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল (সাত হাজার ১১০.০২ একর) বাংলাদেশ দেবে ভারতকে।


ওই পুস্তিকায় আরো বলা হয়, কাগজের হিসাবে ছিটমহল বিনিময়ের ফলে বাংলাদেশের কাছে ভারতের জমি হারানোর মতো বিষয় মনে হলেও বাস্তবে ছিটমহলগুলো অন্য দেশের ভূখণ্ডের মধ্যে অবস্থিত। বাংলাদেশ বা ভারত কোনো দেশের সঙ্গেই ছিটমহলগুলোর ভৌত যোগাযোগ নেই।

বিনিময়ের ফলে ভারতের মধ্যে থাকা ছিটমহলগুলো ভারতের সঙ্গে যুক্ত হবে আর বাংলাদেশের মধ্যে থাকা ছিটমহলগুলো যুক্ত হবে বাংলাদেশের সঙ্গে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।