মোদী-মমতার বৈঠক, কি পেলো পশ্চিম বঙ্গ?
2015.05.11

দু’দিনের পশ্চিমবঙ্গ সফর শেষ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। শনিবারের নজরুল মঞ্চই হোক বা রাজভবন, অথবা রবিবারের বার্নপুরে ইস্কো-র কারখানা, পর্যবেক্ষকদের নজর কেড়েছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সম্পর্কের সহজ সৌজন্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘রোশনি চাঁদ সে হোতি হ্যায়, সিতারোঁ সে নেহি, কাম প্যার মোহাব্বতসে হোতা হ্যায়, বদনামি সে নেহি।’ নরেন্দ্র মোদীও বললেন, ‘ভোটের আগে আমিও অনেককে আক্রমণ করেছি, অনেকে আমায় আক্রমণ করেছেন। কিন্তু এখন সে সব মনে রাখলে চলবে না।’
পারস্পরিক সৌজন্যের পাশাপাশিই রাজ্যের জন্য একগুচ্ছ দাবিদাওয়া পেশ করলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার মধ্যে ছিল পশ্চিমবঙ্গের ঋণ মকুবের প্রসঙ্গও। অবশ্য, ঋণ মকুব করা প্রত্যক্ষ ভাবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে নয়। সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত করতে পারে একমাত্র অর্থ কমিশন। তা ছাড়াও, বিভিন্ন খাতে আরও বেশি কেন্দ্রীয় অর্থের দাবি পেশ করলেন মুখ্যমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট কোনও প্রতিশ্রুতি দেননি। তবে, মুখ্যমন্ত্রীর সুরেই বলেছেন, রাজ্য যদি কেন্দ্রের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে, তবেই উন্নয়ন সম্ভব। তিনি বলেন, ভারতে এখন সহযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাভিত্তিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার যুগ। কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, গোয়া, রাজস্থান, পঞ্জাবের মতো রাজ্য আর্থিক ভাবে যতখানি উন্নত হয়েছে, ভারতের পূর্ব প্রান্তের রাজ্যগুলি তা পারেনি। তবে, তিনি জানালেন, পূর্ব ভারতের উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় সরকার চেষ্টা করবে। তাঁর ভাষায়, ‘পশ্চিমবঙ্গ, এবং কলকাতা, শক্তিশালী না হলে ভারতের পক্ষেও শক্তিশালী হওয়া সম্ভব নয়।’ তাঁর ভাষণটি ইতিবাচক, তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের এক অংশের অভিমত, এতে রাজনীতি যতখানি রয়েছে, অর্থনীতি তার তুলনায় কম।
অর্থনীতির খাতায় এই সফরের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বার্নপুরে ইসকো স্টিল প্লান্টের পুনর্জন্ম। ১৬,৪০৮ কোটি টাকা খরচ করে সংস্থাটির আধুনিকীকরণ হয়েছে। তারই উদ্বোধন করলেন নরেন্দ্র মোদী। আর সে দিনই স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া জানিয়ে দিল, এখানেই শেষ নয়। আগামী ১০ বছরে আরও ১৮,৫০০ কোটি টাকা খরচ করা হবে। উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণ করা হবে ইসকো-র। তা দাঁড়াবে বছরে ৫৬ লক্ষ টনে। দুর্গাপুর স্টিল প্লান্টের উৎপাদন ক্ষমতাও বছরে ৩০ লক্ষ টন থেকে ৯০ লক্ষ টন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, এটি তাঁর বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। ভারতকে আকরিক লোহা থেকে ইস্পাত তৈরির কাজে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলতে হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের ইস্পাত উৎপাদন ক্ষমতা ৩০ কোটি টনে নিয়ে যাওয়া হবে।
পশ্চিমবঙ্গ যখন বড় বিনিয়োগের অভাবে ধুঁকছে, তখন বার্নপুর-দুর্গাপুরের এই বিনিয়োগ কি হাল ফেরাতে পারে রাজ্যের অর্থনীতির? বিশেষজ্ঞরা সন্দিহান। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত হওয়ার পরের সময়ের সিংহভাগই সংস্থাটি ক্ষতিতে চলেছে। বেশ কয়েক বার বিলগ্নিকরণের চেষ্টাও হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি সেই প্রচেষ্টা।
ইনস্টিটিউট অব স্টিল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড গ্রোথ-এর মহাসচিব সুসীম বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘ইসকো-কে লাভজনক করে তোলা কঠিন কাজ।’ তিনি জানালেন, সংস্থার উৎপাদন ব্যয়ই একমাত্র সমস্যা নয়। কী গোত্রের ইস্পাত তৈরি হচ্ছে, সেটাও প্রশ্ন। ইসকো-য় প্রধানত তৈরি হয় টিএমটি বার, ওয়্যার রড বা বিম-এর মতো পণ্য, যার মূল ব্যবহার নির্মাণ ক্ষেত্রে। এই গোত্রের ইস্পাত কোনও প্রকল্পে এক বার ব্যবহৃত হলে স্বভাবতই সেখানে দ্বিতীয় চাহিদার সম্ভাবনা কার্যত শূন্য। অন্য দিকে, ফ্ল্যাট স্টিল ব্যবহৃত হয় গাড়ি বা ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে। কাজেই, প্রথম গোত্রের ইস্পাত নির্মাণ করে লাভজনক থাকতে হলে বিপণনে বিশেষ ভাবে জোর দেওয়া প্রয়োজন। ইসকো সেই কাজ কতখানি পারবে, সে বিষয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা।
এক বৃহৎ বেসরকারি ইস্পাত সংস্থার সর্বোচ্চ কর্তা বললেন, পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির প্রভাব এতই বেশি যে, কোনও শিল্পই চালানো মুশকিল। ইসকো-র কর্মীসংখ্যা প্রায় পঁচিশ হাজার। ট্রেড ইউনিয়নের জঙ্গিপনা সামলে ইসকো কত দূর চলতে পারবে, সন্দেহ আছে। টাটা স্টিল, মিত্তল স্টিলের মতো সংস্থা অতীতে ইসকো কিনতে আগ্রহী হয়েও শেষ অবধি হাত গুটিয়ে নিয়েছিল এই ভয়েই।
অর্থনীতিবিদ দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় তাই বললেন, অর্থনীতি নয়, গল্পটা শেষ অবধি দাঁড়িয়েছে রাজনীতির। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিয়েছেন, ১৯৯৮ সালে তিনি অটলবিহারী বাজপায়ীর কাছে যে বেঙ্গল প্যাকেজ দাবি করেছিলেন, তার মধ্যে ইসকো-র আধুনিকীকরণও ছিল। কংগ্রেস আবার প্রশ্ন তুলেছে, কেন প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে এক বারও মনমোহন সিংহ বা তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কথা উল্লেখ করলেন না। প্রণববাবুর আমলেই ইউপিএ সরকার ইসকো-র আধুনিকীকরণের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছিল। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চোধুরীর তীর্যক মন্তব্য, ‘কাজ করল ইউপিএ সরকার। আর মোদী ফিতে কেটে এমন ভাব করছেন যেন বাংলার জন্য কত কিছু করলেন।’
রাজনৈতিক দর্পনে অর্থনীতির যুক্তি ঢাকা পড়ে যাওয়ার চেনা ছকেই আটকে থাকল পশ্চিমবঙ্গ।