পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডে তিন অভিযুক্তই দোষী সাব্যস্ত হল
2015.12.10

স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাকে বলেছিলেন ‘সাজানো ঘটনা’, সেই পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডে তিন অভিযুক্তকেই দোষী সাব্যস্ত করলেন নগরদায়রা আদালতের বিচারক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য। অভিযুক্ত নাসের খান, রুমান খান ও সুমিত বাজাজকে ৩৭৬ (২)(জি) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করেছেন বিচারক। প্রথম দুই অভিযুক্ত ভারতীয় দণ্ডবিধির ৫০৬, ৩২৩, ১২০ (বি) ও ৩৪ ধারাতেও দোষী সাব্যস্ত হয়েছে।
আদালতে দাঁড়িয়েই ধর্ষিত সুজেট জর্ডনের বাবা পিটার জর্ডন বললেন, ‘অভিযোগটি যে সাজানো ছিল না, আদালতের রায়ে তা প্রমাণ হয়ে গেল।’ সুজেটের মা ক্যারেন বললেন, ‘আজ সুজেট জয়ী হল। অভিযুক্তদের শাস্তি হওয়ায় আমরা খুশি।’
সুজেট অবশ্য তাঁর জয় দেখে যেতে পারলেন না। ধর্ষণের যন্ত্রণা, এবং তার পর রাজ্য প্রশাসনের চরম ঔদাসীন্যের বিরুদ্ধে সাহসী লড়াই লড়তে লড়তেই গত মার্চ মাসে এনকেফেলাইটিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান চল্লিশ বছরের সুজেট।
কী ঘটেছিল ২০১২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি?
পার্ক স্ট্রিটের এক অভিজাত হোটেলের সামনে থেকে ৩৭ বছর বয়সী বিবাহবিচ্ছিন্না সুজেটকে গাড়িতে তোলে পাঁচ যুবক। চলন্ত গাড়িতেই ধর্ষিতা হন সুজেট। তার পর তাঁকে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডের ওপর এক্সাইড মোড়ে ফেলে দিয়ে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা।
৮ ফেব্রুয়ারি পার্ক স্ট্রিট থানায় ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করেন সুজেট। কিন্তু তাঁর অভিযোগে গা করেনি পুলিশ। সংবাদমাধ্যমে ঘটনাটি প্রকাশ হওয়ার পরই নড়েচড়ে বসে লালবাজার। ঘটনার তদন্তভার তুলে দেওয়া হয় গোয়েন্দাবিভাগের হাতে। দুই যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু তাদের সঙ্গে ঘটনার সম্পর্ক না থাকায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে চিহ্নিত করা হয় পাঁচ অভিযুক্তকে।
কিন্তু তারই মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, অভিযোগটি নিতান্তই ‘সাজানো ঘটনা’। শুধু তা-ই নয়, তাঁর সরকারের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করতেই এই চক্রান্ত বলে অভিযোগ করেন তিনি। কলকাতা পুলিশের তৎকালীন কমিশনার রঞ্জিৎ পচনন্দাও এক সাংবাদিক সম্মেলন করে কার্যত একই কথা বলেন। বর্তমানে সারদা-কাণ্ডে জেলবন্দি মদন মিত্র সহ রাজ্যের বেশ কয়েক জন মন্ত্রী, শাসক দলের কিছু সাংসদ ও বিধায়ক সুজেটের চরিত্র নিয়ে কদর্য ইঙ্গিত করেন।
হাল ছাড়েননি শুধু কলকাতা পুলিশের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার দময়ন্তী সেন। তিনি জানান, ঘটনাটি সাজানো নয়, সুজেটকে সত্যিই গণধর্ষণ করা হয়েছে। তাঁর উদ্যোগেই গ্রেফতার হয় নাসের, রুমান ও সুমিত। তবে, এই সৎসাহসের মূল্য চোকাতে হয়েছিল দময়ন্তীকে। মুখ্যমন্ত্রীর রোষানলে পড়েন তিনি। তাঁকে ব্যারাকপুরের পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দায়িত্ব দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়।
কী ভাবে কোনও তদন্ত হওয়ার আগেই মুখ্যমন্ত্রী বলে দিতে পারেন ঘটনাটি সাজানো, সেই প্রশ্নে রাজ্যের নাগরিক সমাজে বিপুল আলোড়ন হয়। তবে, মুখ্যমন্ত্রী তখন তাঁর অবস্থান থেকে সরেননি। আজ আদালতের রায়প্রকাশের পর অবশ্য তিনি আর ‘সাজানো ঘটনা’ তত্ত্বের পুনরাবৃত্তি করেননি। বলেছেন, ‘আদালতের রায়কে আমি স্বাগত জানাচ্ছি।’ জানা গিয়েছে, ঘনিষ্ঠ মহলে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তিনি চান যে দোষীদের কঠোরতম শাস্তি হোক।
প্রশ্ন অবশ্য থাকছে। ঘটনার প্রায় চার বছর পরেও দুই মূল অভিযুক্ত কাদের ও আলি এখনও অধরা। অভিযোগ, কাদের রাজ্যের শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণেই তাঁকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। লালবাজার সূত্রে অবশ্য এই জল্পনাটিকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জানা গিয়েছে, এই দুই অভিযুক্তের জন্য নতুন করে চার্জশিট পেশ করতে হবে পুলিশকে।
আদালতের রায়কে স্বাগত জানাচ্ছে কলকাতার নাগরিক সমাজ। এক বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মী পিয়াশা চক্রবর্তী বললেন, ‘এত দিন মনে হচ্ছিল, এই রাজ্যে ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকুও আর নেই। ধর্ষিত হলেও মেয়েদের ওপরই দোষ চাপবে। আদালতের রায়ে ভরসা পাওয়া গেল যে এখনও পশ্চিমবঙ্গে ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব।’
বিজ্ঞাপনকর্মী অভিষেক সেনগুপ্ত বললেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের পুলিশের ওপর কোনও ভরসা নেই। আদালতের রায়ে যদি পুলিশের হুঁশ ফেরে, যদি শুধু শাসকদলের কথায় ওঠা-বসা বন্ধ করে পুলিশ সত্যিই আইনের পথে চলতে আরম্ভ করে, তবে পশ্চিমবঙ্গের উপকার হবে।’
সমাজতত্ত্ববিদ অনন্যা চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘এই ধর্ষণকাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য করার কোনও প্রয়োজনই ছিল না। ধর্ষণ অতি নিন্দনীয়, কিন্তু তার জন্য কেউ সরকারকে দোষী ঠাওরায় না। মুখ্যমন্ত্রী সেধে দায়টি নিজের ঘাড়ে টেনে এনেছিলেন। এবং, তার ফলে তদন্তে প্রচুর অসুবিধা হয়েছে। প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকলে আরও একটু সতর্ক হওয়া উচিত।’
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক পৃথা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিলেন, ‘ধর্ষিতারা সচরাচর নিজেদের পরিচয় গোপন রাখেন। ভারতের অবস্থা এমনই যে ধর্ষণের শিকার হলেও লজ্জা যেন মেয়েটিরই। সেখানে সুজেট প্রকাশ্যে এসেছিলেন। গণমাধ্যমে নিজের কথা বলেছিলেন। তাঁর মনের জোর প্রশংসনীয়। তিনি এই সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, ধর্ষিতা হওয়া তাঁর লজ্জা নয়, লজ্জা এই সমাজের। সুজেট নিজের জয় দেখে যেতে পারলেন না, এটাই দুঃখের।’
নগরদায়রা আদালতের রায়ের পর কলকাতার প্রতিক্রিয়া বলে দিচ্ছে, এই জয় শুধু সুজেটের নয়, গোটা শহরের।