মিয়ানমারের চাইতে দিল্লির বস্তির জীবন অনেক ভালো, বলছে রোহিঙ্গারা
2015.05.19

ভালো থাকার আশায় বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রায় ২ লাখ শরনার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।
দক্ষিণ-পুর্ব দিল্লির পরিত্যাক্ত এলাকায় বাঁশের নির্মিত ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র পরিচয় হীন রোহিঙ্গা মোহাম্মদ সলিম উল্লাহর জানা নেই তার স্বজাতির মানুষ দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে। তবে এই খবরে সে অবাক হয়নি।
“সবচেয়ে দুঃসহ ঘটনা আমাদের মানুষ-জনের জীবনে ঘটে চলেছে” ২৭ বছর বয়েসি সলিম জানায় বেনার নিউজকে।
হাজার হাজার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি থাই-মালয় ও ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় ঘুড়-পাক খাচ্ছে, কোনো দেশ তাদেরকে নিতে চাইছে না। অসুস্থ, ক্ষুধার্ত ও অসহিষ্ণু হয়ে অনেকে নিজের মূত্র পান করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে।
সলিম জানায়, “বার্মায় আমাদের অভিভাবকদের আমাদের চোখের সামনেই হত্যা করা হয়েছে, মাদেরকে ধর্ষণ করা হয়েছে তাদের ছেলেমেয়েদের সামনে, আমাদেরকে কুকুরের মতো করে মার-পিট করা হয়েছে”।
২০১২ সালে বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারের পশ্চিম রাখাইনে প্রায় ১০ লাখ মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির বসবাস ছিলো। সেখান থেকে সলিম তার স্ত্রী ও দুই বছরের ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশ হয়ে ভারতে চলে আসে।
“এই নির্মমতা চলে কয়েক বছর ধরে, কেউ আমাদেরকে সাহায্য করতে আসে নি, এখন কি করে সব বদলে যাবে?” জানায় সে। তার পরিবার এখন আরো ৬০ জন পরিবার সহ ভারতের রাজধানীর কালিন্দি কুঞ্জের বস্তি এলাকায় বাঁশের তৈরি ঘর বানিয়ে বসবাস করছে। কাছেই সে একটা মুদির দোকান দিয়েছে। চকলেট থেকে শুরু করে চিপ্স মশার কোয়েল ইত্যাদি সামগ্রী বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছে।
মুক্তির নিঃশ্বাস
ভারতে আশ্রিত হয়েছে আফগানিস্থান,তিব্বত, সোমালিয়া ও মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় ২ লাখ শরনার্থী। কিন্তু আইনগত কোনো কাঠামোতেই তাদের চিহ্নিত ও সুরক্ষার ব্যবস্থা নাই।
যে বস্তিতে সলিম বাস করে সেখানে কোনো বিদ্যুৎ,খাবার পানি ও পায়খানার ব্যবস্থা নাই। সেখানকার ১৬০ অধিবাসীদের কেউ কেউ দিন মজুর হিসেবে দিনে ৩০০ রুপি (৪.৭০ ডলার) মজুরিতে কাজ করে।তাদের খোলা-মেলা মলমূত্র ত্যাগে তাদের বাসস্থানের পাশ দিয়ে প্রবাহিত যমুনা নদীর পানি নোংরা হয়ে পড়েছে।
সলিম উল্লাহ জানায়, “তারপরও আমি অন্তত স্বাধীনভাবে আমার ধর্ম পালন করতে পারি, যা আগে পারছিলাম না, সেজন্য আমাকে হত্যাই করতো। আমার অন্তত আশা যে ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারবো, তারা আরো ভালো জীবন পাবে”।
তার স্বপ্ন তার ৫ বছরের ছেলে তামিম একদিন স্কুল পাশ করবে।
সংখ্যা কত অজানা
সলিম ভারতের দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান,জম্মু ও কাশ্মির এবং অন্যান্য স্থানে আশ্রয় নেয়া ৮ হাজার ৬৩০ জন রোহিঙ্গাদের একজন।জাতিসংঘের শরনার্থী পুনর্বাসন সংস্থা তাদের নাম নিবন্ধন করেছে।
সংস্থার মুখপাত্র সুচিত্রা মেহতা বেনার নিউজকে ইমেইলে জানান, “যতক্ষন আমাদের তথ্য বাছাইয়ের মাধ্যমে আমাদের কাছে নিবন্ধিত নয় ততক্ষন আমরা বলতে পারবো না অনিবন্ধিত কতজন রোহিঙ্গা ভারতে আশ্রয় নিয়েছে”।
১৯৮২ সালে মিয়ানমারে নাগরিকত্বের এক আইন পাশের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বাঙ্গালি ও রাষ্ট্রহীন ঘোষণা করা হয়।এতে তারা কোনো পরিচয়পত্র পাবে না। স্কুলে ভর্তি,বিবাহ, চাকুরি ও জন্মের সনদ পত্র এইসবের জন্য তার দরকার হয়।
২০১২ সালে রাখাইনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কয়েকশ রোহিঙ্গার মৃত্যু ঘটে।হাজার হাজার এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য দেশে পালানো শুরু করে, এই আশায় যে কোথাও ভালো জীবন পাবে।
ভারতে আশ্রয় নেয়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ও অন্যান্য দেশের আশ্রিতরা ইউএনএইচসিআর-এর দেয়া আইডি কার্ডের মাধ্যমে বিশেষ সুরক্ষা পাবে। গ্রেফতার, আটক ও ডিপোর্টেশন থেকে রেহাই পাবে, জানান মেহতা।
তাদের কিছু সংখ্যক খুব হতদরিদ্র যারা, তারা সংস্থা থেকে যৎসামান্য ভাতা পাচ্ছেন।
ভালো অবস্থার খোঁজে
জাতিসংঘ চিহ্নিত রিফিউজি হওয়া সত্তেও মুসলিম রোহিঙ্গারা ভারতে বৈষম্যের শিকার।
চা বিক্রেতা মোহাম্মদ হারুন,৪১, জানায়, “ আমরা ভাসমান কাজকর্ম করে খাই, কারণ কেই আমাদের চাকরি দেয় না, কেই রিফিউজিকে নিয়োগ দেয় না, বিশেষ করে মুসলিম রিফিউজিকে”।সে দিনে মাত্র ২০০ রুপি রোজগার করে।
“ বার্মায় আমার পরিবারের ১৫ একর কৃষি জমি ছিল। ২০১২ সালের দাঙ্গায় সে জমিগুলো কেড়ে নেয়া হয়। পড়নের কাপড় ছাড়া আমরা সাথে করে কিছুই আনতে পারি নাই”। হারুন জানায় বেনার নিউজকে।কালিন্দি কুঞ্জের বস্তিতে সে ১২ ফুট বাই ১২ ফুটের একটা ঘরে থাকে দুই বোন ও দুই কিশোর ভাগনিদের নিয়ে।
আমার এই অবস্থা দেখার জন্য ভারতের কোনো কর্মকর্তা আসে নাই।“ দুই বছর আগে তিনটি বাচ্চা সাপের কামড়ে মারা যায়, কারণ এখানকার হাসপাতাল তাদেরকে চিকিতসা দেয় নাই, কোনো বৈধ কাগজ নেই বলে”।
ভারতের যাকাত ফাউন্ডেশনের এস এম আমানুল্লাহ যিনি এই বস্তির জায়গা জমির মালিক, তিনি এই দূর্ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন।
“ আমরা সরকারের কাছে এখানে প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারের জন্য এক তলা বাসা নির্মাণের অনুমতি চেয়েছি, কিন্তু সে অনুমতি দেয়া হয় নাই। কারণ দেখায়, নীচু জমিতে কোনো নির্মাণ কাজ করা ঠিক নয়”, বলেন তিনি।
আমানুল্লাহ আরো বলেন, “সরকার রোহিঙ্গাদের মাইনোরিটি হিসেবে গন্য করছে না। তাদের জন্য বিকল্প জমির ব্যবস্থা করা প্রশ্নই আসেনা। কালিন্দি কুঞ্জে ১১ শ গজের এই জায়গাটাই আমাদের আছে কেবল”।
২০১৩ সালে হিউম্যান রাইটস ল’ইয়ার নেটওয়ার্ক ভারতের সুপ্রিম কোর্টে ১৫০ রোহিঙ্গা পরিবারের উন্নত জীবন লাভের সুযোগ দিতে দিল্লিতে ও হরিয়ানায় স্থান দিতে এক মামলা দায়ের করেছে। এর শুনানি জুলাইতে হবার কথা।
‘নির্ভয়ে খেতে পাই’
সরকারের সকল অবহেলা সত্তেও কোনো দুঃখ নেই সামজিদা বেগমের। ২০১২ সালে মিয়ানমারের দাঙ্গায় যার স্বামী মারা যায়। সে এখানে এসে বসবাস করতে চায় নি।
সামজিদা বলেন, “ আমি এখানে দুবেলা খেতে পাই কোনো ভয়-ডর ছাড়াই সেটাই যথেষ্ঠ”। তার এক ৪-বছরের ছেলে রয়েছে, কাজের ফাকে ফাকে তাকে দেখাশুনা করে। আরো জানান, “মিয়ানমার যা খুশি করুক গা, আমি আর সেখানে কখনো ফিরে যাবো না”।