কলকাতার যানজটে বছরে ক্ষতি বহু কোটি টাকা
2016.02.03
যানজটে আটকে থাকার একমাত্র কুফল বিরক্তি? তেমনটা ভাবলে মস্ত ভুল করবেন।
দুই অর্থনীতিবিদের সমীক্ষা বলছে, কলকাতার দশটি বড় রাস্তায় দিনে মাত্র দু’ঘণ্টা সময় যে যানজট হয়, তাতে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ দুই কোটি টাকারও বেশি।
দিনে মাত্র দু’ঘণ্টা, তাও মাত্র দশটা রাস্তা। তাতেই যদি ক্ষতির পরিমাণ এত হয়, তবে দুই বেলার ভিড়ের মোট সাত ঘণ্টায়, শহরের সব বড় রাস্তা মিলিয়ে, ক্ষতির অঙ্কটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, অনুমান করা যায়। এবং, সেই হিসেবের মধ্যেও পরিবেশ দূষণের ক্ষতি, অথবা সেই দূষণ থেকে হওয়া দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের ক্ষতি ধরা নেই। সেগুলোও যোগ করলে কলকাতার যানজটের আর্থিক মাপ বাড়বে আরও কয়েক গুণ।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর আরবান ইকনমিক স্টাডিজ-এর দুই অর্থনীতিবিদ, অপরাজিতা চক্রবর্তী ও সুদক্ষিণা গুপ্ত, এই ব্যতিক্রমী সমীক্ষাটি করেছেন। কলকাতার দশটি প্রধান রাস্তায় দিনে দু’ঘণ্টা, সকাল নটা থেকে দশটা, আর সন্ধে ছটা থেকে সাতটা অবধি যানজটে যত গাড়ি আটকে থাকে, অথবা শম্বুকগতিতে চলে, তার ফলে কত টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়, তাঁরা সেই হিসেব কষেছেন।
সেই ক্ষতির হিসেবে যে অঙ্কগুলি ছিল, সেগুলি হল, যানজটে আটকে থাকার ফলে যে সময় নষ্ট হয়, সেই সময়টুকু কাজে লাগাতে পারলে তার থেকে যত আর্থিক লাভ হত; এবং, ইঞ্জিন চালু অবস্থায় যানজটে আটকানোর ফলে যে তেল পোড়ে, তার দাম। যানজট ছাড়াই রাস্তায় চললে যত তেল খরচ হয়, যানজটের ফলে শম্বুকগতিতে চললে তার দ্বিগুণ তেল পোড়ে।
দুই অর্থনীতিবিদের হিসেব বলছে, তাঁদের বেছে নেওয়া দশটি রাস্তায় দিনে দু’ঘণ্টাতেই প্রতি দিন প্রায় পঁচাত্তর হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। অর্থাৎ, বছরে দু’কোটি টাকারও বেশি। অনুমান করা চলে, দিনে যানজটের সাত ঘণ্টায় এই ক্ষতির মাপ অন্তত তিন গুণ বেশি। শহরের সব বড় রাস্তার হিসেব কষলে তা বাড়বে আরও কয়েক গুণ।
অর্থাৎ, যানজটের ফলে প্রত্যক্ষ আর্থিক ক্ষতির পরিমাণই বছরে প্রায় ত্রিশ কোটি টাকা। এর পাশাপাশি রয়েছে পরিবেশের ক্ষতি, এবং দূষণের ফলে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের ক্ষতি। সব মিলিয়ে অঙ্কটা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতোই।
শহরের রাস্তায় যানজটের ছবিটা ঠিক কেমন? সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, শহরের অন্যতম ব্যস্ত রাস্তা মহাত্মা গাঁধী রোডে অফিস বেলায় গাড়ির গতি ঘণ্টায় বড় জোর নয় কিলোমিটার। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডে ঘণ্টায় আঠারো কিলোমিটার, আর জি কর রোডেও তাই। গাড়ির গতি সবচেয়ে বেশি বিবেকানন্দ রোডে, ঘণ্টায় চল্লিশ কিলোমিটার। অর্থাৎ, অফিস বেলায় কলকাতার রাস্তায় গাড়ির গড় গতি বড় জোর সাইকেলের সমান!
গোটা দেশে কলকাতাতেই এই সমস্যা সর্বাধিক। কারণ, দিল্লি বা মুম্বইয়ের তুলনায় কলকাতার রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কম হলেও রাস্তার মাপ এই শহরে খুবই কম। তার ফলে কলকাতার রাস্তায় গাড়ির ঘনত্ব, অর্থাৎ প্রতি বর্গ কিলোমিটার রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা, গোটা দেশে সর্বাধিক।
যত দিন যাচ্ছে, যানজটের সমস্যা তত জটিলতর হচ্ছে কেন? সুদক্ষিণা গুপ্তর মতে, “শহরে যানজট বাড়লে লোকে আরও বেশি করে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করছেন। একটা বাস রাস্তায় যতখানি জায়গা নেয় এবং যত লোককে বহন করে, সেই তুলনায় গাড়ি মাথাপিছু যাত্রীর জন্য অনেক বেশি রাস্তা দখল করে। অর্থাৎ, যানজটের সমস্যা এড়াতে শহরের মানুষ আরও বেশি যানজট সৃষ্টি করার পথেই হাঁটেন।“
তবে, এই সমস্যা শুধু কলকাতার নয়, গোটা দুনিয়ারই, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির। দিল্লির অর্থনৈতিক গবেষণা কেন্দ্র টেরি-র অর্থনীতিবিদ শাশ্বত চৌধুরী বললেন, “সরকারি স্তরের চিন্তাভাবনাতেই মূল সমস্যা। যানজটের সমাধান হিসেবে ভারতের সব শহরেই রাস্তা বাড়ানো হয়েছে। যেহেতু মাটিতে জায়গা নেই, তৈরি হয়েছে উড়ালপুল”।
তিনি আরো বলেন, “কলকাতার কথাই ভাবুন, কতগুলো নতুন উড়ালপুল হয়েছে। কিন্তু সেই উড়ালপুলগুলো শুধু ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য। যেখানে গণপরিবহনে জোর দেওয়ার কথা, সেখানে সরকার ঠিক উল্টো কাজটা করেছে। কিন্তু গোটা দুনিয়ার অভিজ্ঞতা বলছে, উড়ালপুল তৈরি করে দীর্ঘমমেয়াদে যানজটের সমস্যার সমাধান করা যায়নি।”
বিশিষ্ট চিকিৎসক নিবীত পুরকায়স্থ বললেন, “এই সমীক্ষায় যে ক্ষতির ছবিটা ধরা পড়েছে, সেটা বড় জোর হিমশৈলের চূড়া। দেশের প্রতিটা বড় শহরে শিশুরা শ্বাসকষ্টের শিকার হচ্ছে। ফুসফুসের বিভিন্ন সমস্যা থেকে ক্যান্সার, সবই বাড়ছে বায়ুদূষণের ফলে। সেই ক্ষতির আর্থিক মাপ কত, হিসেব কষলে মাথা ঘুরে যাবে।”
স্বাস্থ্যের ক্ষতি যে শুধু শারীরিক, তা-ও নয়। মনরোগ বিশেষজ্ঞ দেবশ্বেতা চক্রবর্তী বললেন, “প্রাত্যহিক যানজট মানুষের মনের ওপর বিপুল চাপ ফেলে। কাজ করার ইচ্ছে চলে যায়, অবসাদ আসে। যাঁরা রোজ অফিস যাতায়াতের পথে যানজটে আটকে পড়েন, তাঁদের উৎপাদনশীলতা তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে কম।”
সব মিলিয়ে বিপুল ক্ষতির মুখে দাঁড়িয়ে আছে কলকাতা। ভারতের অন্য বড় শহরগুলির ছবিও একই রকম। সমাধানের পথ? বিশেষজ্ঞরা সমস্বরে বলছেন, গণপরিবহনের ওপর জোর দিতেই হবে। মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্তরা যাতে বাসে-মেট্রোয় যাতায়াত করেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। বাস-মেট্রোর পরিকাঠামোর উন্নতি প্রয়োজন। আর, ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর বসাতে হবে চড়া হারের কর। শহরের রাস্তায় যে প্রথম অধিকার গণপরিবহনের, এই কথাটি অবিলম্বে স্বীকার না করলেই নয়।
সরকার এই পরামর্শে কান দেবে কি? না কি, ভারতের শহরগুলি এগিয়ে যাবে সুনিশ্চিত ধ্বংসের পথে? কলকাতার যানজটের সমীক্ষা গোটা দেশকে এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল।