জেএমবির ৪ নারী সদস্য গ্রেপ্তার
2016.08.16

দেশজুড়ে জঙ্গি দমন অভিযানে এবার ধরা পড়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন জামায়াতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশ—জেএমবির চার নারী সদস্য; যাদের তিনজন বেসরকারি মানারত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং একজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক।
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন জেএমবির নারী সদস্য গ্রেপ্তার হলেও শিক্ষা ও সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় এই চারজনের অবস্থান বেশ ওপরে।
সর্বশেষ গত ২৪ জুলাই দিবাগত রাতে জেএমবির পাঁচ নারী সদস্যকে সিরাজগঞ্জের মাসুমপুর উত্তরপাড়া মহল্লার একটি বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করেছিল গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের স্বামীরাও জেএমবির সদস্য বলে পুলিশ সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিল।
র্যাবের সংবাদ সম্মেলন
ঢাকা ও গাজীপুরে অভিযান চালিয়ে গত কয়েকদিনে জেএমবির চার নারী সদস্যকে গ্রেপ্তার করার কথা জানায় র্যাব। মঙ্গলবার মিরপুরের পাইকপাড়ায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৪ এর অধিনায়ক খন্দকার লুৎফুল কবীর গ্রেপ্তারকৃতদের নাম–পরিচয় প্রকাশ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ওই দলের প্রধান মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের স্নাতক (সম্মান) চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী আকলিমা রহমান ওরফে মণি। আকলিমাই বাকি তিনজনকে দলে ভিড়িয়েছে।
এরা হচ্ছে; ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ইসতিসনা আক্তার, মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের ছাত্রী ইশরাত জাহান ওরফে মৌসুমি ওরফে মৌ এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদিজা পারভিন ওরফে মেঘলা।
“জেএমবির ওই নারী সদস্যরা নিয়মিত আল কায়েদা ও আইএস নেতাদের বক্তব্য শুনতেন। আইএসের বিভিন্ন সাইটে যেতেন। সিরিয়া ও ইরাকে আইএসের নৃশংসতাকেও তারা সমর্থন করেন,” সংবাদ সম্মেলনে জানান খন্দকার লুৎফুল কবীর।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষার্থীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের আরও দুই ছাত্রী, মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের একজন প্রভাষক এবং গুলশান ও ধানমন্ডির দুই আরবি শিক্ষকের নাম তাদেরকে জানিয়েছে।
“অভিজাত পরিবারের এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরাও জঙ্গি হচ্ছে, বিষয়টি উদ্বেগজনক।এর আগে আমরা দেখেছি যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কয়েকজন জঙ্গি হিসেবে ধরা পড়েছে, হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছে,” বেনারকে জানান নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইশফাক এলাহী চৌধুরী।
সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তা বলেন, প্রথমবারের মতো উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত পরিবারের মেয়েদের এ ধরনের উগ্র কর্মকাণ্ডে জড়াতে দেখা গেল। এটা ভাবিয়ে তোলার মতো ঘটনা এবং এ থেকে রক্ষার উপায় খুঁজতে হবে।
যেভাবে সন্ধান পাওয়া গেল
গত ২১ জুলাই র্যাব জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলীয় শাখার কমান্ডার মো. মাহমুদুল হাসানকে গ্রেপ্তার করে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রথমে গাজীপুরের সাইনবোর্ড এলাকার বাসা থেকে আকলিমা রহমানকে এবং পরে অন্যদের গ্রেপ্তার করা হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ইসমাইল খান বেনারকে বলেন, “জেএমবি সন্দেহে গ্রেপ্তার শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ইসতিসনা আক্তার ঐশী ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে-৬৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী। তার জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার তথ্য কর্তৃপক্ষের জানা ছিল না।”
র্যাবের অনুসন্ধানে জানা গেছে, আকলিমা গত বছরের শুরুতে গাজীপুরের হাজির পুকুর এলাকার একটি মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে যায়। মসজিদের নিচতলার একটা লাইব্রেরিতে আনসার উদ্দীন নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ওই ব্যক্তির কাছ থেকে সে জেএমবি নেতা জসিমউদ্দীন রাহমানীর বই সংগ্রহ করে। এরপর দলটির আরেক নেতা মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
আকলিমা ২০১৫ সালের শেষের দিকে ইসতিসনা, ইশরাত ও মেঘলাকে দাওয়াত দেয়। সে বাংলায় ভাষান্তরিত আনওয়ার আল আওলাকির প্রায় অর্ধশত বক্তৃতার অডিও সিডি তাদের শুনতে দিয়েছিল।
এ সময় তাদের সঙ্গে মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের এক প্রভাষকের যোগাযোগ হয়। ওই শিক্ষক তাদের গুলশান এক নম্বরে এক আরবি শিক্ষকের বাসায় নিয়ে যেত। সেখানে তারা আইএস এর বিভিন্ন অডিও–ভিডিও দেখান হত।
আকলিমা রহমানকে র্যাব গত ১৫ আগস্ট রাত ২টার সময় গাজীপুর সাইনবোর্ড এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ইসতিসনা আক্তারকে একইদিন তার মগবাজারের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। অনুসন্ধানে র্যাব জানতে পেরেছে, ইসতিসনার কিছু বিদেশি বন্ধুবান্ধব আছে। তাদের মাধ্যমে সে আইএসের বিভিন্ন অভিযান, তাদের প্রচারিত তত্ত্ব সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করত।
২০১৬ সালের এপ্রিল–মে মাসের দিকে আকলিমা তাকে (ইসতিনাকে) জানায়, আইএসে যোগ দেওয়া এক ভাই খুব কষ্টে আছে। তাকে কিছু টাকা পাঠানো দরকার। আকলিমার কথা মতো ইসতিসনা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকা বিকাশ করে পাঠায়।
ইসতিসনার বাবা বিশ্বাস আক্তার হোসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি বেনারকে বলেন, “আমার মেয়ে ছোট বেলা থেকেই ধার্মিক। সম্প্রতি আকলিমা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। সে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ইসলামি বিষয় শেয়ার করত, এটা আমি জানতাম।”
ওই চিকিৎসক জানান, “আমি এখনো বিশ্বাস করি না আমার মেয়ে জেএমবিতে জড়িয়েছে।”
মিরপুর-১ নম্বরের জনতা হাউজিংয়ে অভিযান চালিয়ে গত সোমবার রাত ১০টার দিকে ইশরাত জাহান ওরফে মৌসুমী ওরফে মৌ কে গ্রেপ্তার করে র্যাব। র্যাব বলছে বাসায় র্যাবের সদস্যরা ঢোকার আগেই তিনি মুঠোফোনের মেমোরি কার্ড ধ্বংস করে ফেলেন। পরে র্যাব তল্লাশি চালিয়ে ওই বাসা থেকে জিহাদি বই উদ্ধার করে।
জেএমবির আরেক নারী সদস্য খাদিজাকেও সোমবার রাতে তার মিরপুরের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
গ্রেপ্তার হওয়া চারজনের তিনজন মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। গ্রেপ্তারকৃতরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন ছাত্র–শিক্ষকের নাম বলেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপাচার্য চৌধুরী মাহমুদ হাসান বেনারকে বলেন, “গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিচার হবে—এটাই আমি কেন, সবাই চাইবে।”
উপাচার্য জানান, বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসবিরোধী একটি বৈঠক আছে। ওই বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কীভাবে আরও সহযোগিতা করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করা হবে।