কলকাতায় তাপপ্রবাহ, স্কুল বন্ধ
2016.04.13
ভরদুপুরে উত্তর কলকাতার অভিজাত স্কুলের সামনে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন রুদ্র। তাঁর মেয়ে ওই স্কুলের প্রাথমিক বিভাগের ছাত্রী।
সরকারি স্কুলে ছুটি ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু তাঁর মেয়ের স্কুলটি খ্রিস্টান মিশনারি স্কুল, সেই স্কুলটি কি রাজ্য সরকারের পথ অনুসরণ করে ছুটি ঘোষণা করবে? কলকাতার বেশিরভাগ অভিভাবক এখন সন্তানের পড়াশোনা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায়।
গত তিন দিন ধরে কলকাতায় অভূতপূর্ব তাপপ্রবাহ চলছে। দিনপঞ্জির পাতায় এখনও বৈশাখ মাস পড়েনি। অর্থাৎ, ছোটবেলায় শেখা হিসেব অনুযায়ী এখনও বসন্তকাল। সেই বসন্তেই শহর এমন তেঁতে উঠেছে যে, ইতিমধ্যে হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন মধ্যবয়স্ক এক নাগরিক।
কলকাতার তাপমাত্রা থাকছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। আর, বাঁকুড়ার মতো জেলায় তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। গত চল্লিশ বছরে কলকাতায় এপ্রিল মাসে এর চেয়েও বেশি গরম পড়েছিল এক বারই। সেটি ১৯৮০ সালের ২৫ এপ্রিল। মঙ্গলবার আবহাওয়া দফতর জানায়, আরও অন্তত পাঁচ দিন চলবে এই তাপপ্রবাহ।
এর পরই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ঘোষণা করে দেন, সোমবার থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ থাকবে রাজ্যের সব সরকারি স্কুল।
মন্ত্রীর আদেশের পরই অনিশ্চয়তা বাড়তে থাকে। শহরের বিভিন্ন বেসরকারি স্কুলের সামনে জমতে থাকে উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের ভিড়। বেশিরভাগ বেসরকারি স্কুলই ছুটি ঘোষণা করেনি। বহু স্কুল ক্লাস আরম্ভ হওয়ার সময় এগিয়ে এনেছে।
উত্তর কলকাতার নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ক্যালকাটা গার্লস হাই স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রীর মা তনুশ্রী তরফদার জানালেন, “সকাল আটটার পরিবর্তে স্কুল শুরু হচ্ছে সাড়ে সাতটায়। ছুটির সময় দুপুর পৌণে একটার পরিবর্তে স্থির হয়েছে সকাল দশটা। তনুশ্রী বললেন, এই ব্যবস্থায় অন্তত দুপুরবেলার চাঁদিফাটা গরমটাকে এড়ানো যাচ্ছে।”
মডার্ন হাই সহ একাধিক স্কুল জানিয়েছে, তারা এই সমস্যার ভিন্নতর সমাধানের কথা ভাবছে। গরমের ছুটির সময়টাকেই পাকাপাকি ভাবে এগিয়ে আনা যায় কি না, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। এই ভাবনার যে প্রয়োজন আছে, আবহাওয়ার তথ্যই সেই কথা বলে দিচ্ছে।
আবহাওয়া দফতর সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, গত নয় বছরের মধ্যে সাত বার এপ্রিলে তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রির কোঠা ছাড়িয়েছে। এপ্রিলের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বেড়ে হয়েছে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ, কলকাতায় আগের তুলনায় অনেক দ্রুত গ্রীষ্ম এসে পড়ছে। ফলে, গরমের ছুটি পাকাপাকি ভাবেই এগিয়ে নেওয়ার চিন্তায় যৌক্তিকতা আছে।
কিন্তু যেখানে এমন তাপদাহে সরকারি স্কুল গুলিতে ছুটি ঘোষণা হয়েছে, সেখানে বেসরকারি স্কুলগুলির বেশিরভাগই ছুটি দিল না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বাগুইআটির দ্য চিলড্রেনস হ্যাপি হোম স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সুচরিতা গুপ্ত জানান, “প্রতিটি স্কুল বছরে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক দিনের বেশি ছুটি দিতে পারে না।এখন ছুটি দিলে কাটছাঁট করতে হবে গরমের ছুটি। হয়তো মে মাসের মাঝামাঝিই স্কুল খুলে দিতে হবে। তখনও আবহাওয়ার অবস্থা একই রকম থাকবে। ফলে এখন বাড়তি ছুটি দিলে আর পাঠ্যক্রম শেষ করার উপায় থাকবে না।”
সরকারি স্কুলগুলো তা হলে কী ভাবে সামলাবে? কলকাতার এক নামী স্কুলের দীর্ঘদিনের শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “মন্ত্রী তো ছুটির হুকুম দিয়েই খালাস। এই ছুটি কোথা থেকে পুষিয়ে নেওয়া হবে, না পোষানো গেলে পাঠ্যক্রম শেষ করার কী ব্যবস্থা হবে, এই প্রশ্নগুলোর কোনও উত্তর এখনও নেই।”
“আদৌ কখনও এই উত্তর পাওয়া যাবে কি না, জানি না। স্কুল বন্ধ, কিন্তু শিক্ষকদের হাজির থাকতে হচ্ছে। আমরা কেনই বা আসছি, কেন বসে থাকছি, কিছুই জানা নেই।”
স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকরা তবুও ছাদের তলায় থাকছেন। মাথার ওপর সিলিং ফ্যান থাকছে। কিন্তু এই গ্রীষ্মে কলকাতার রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাঁদের কাজ করতে হয়?
কলকাতা পৌরসভা জঞ্জাল সাফাই বিভাগের ঠিকাদার প্রদীপ পাল বলেন, “নির্বাচনের বাজারে এক মুহূর্তও ছুটি নেই। যতই গরম থাক, প্রাণ যতই হাঁসফাঁস করুক, রাস্তায় দাঁড়িয়ে জঞ্জাল সাফাইয়ের তদারকি করতে হচ্ছে রোজ।”
কলকাতা পুলিশের ট্রাফিক সার্জেন্ট সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়ও জানালেন, ‘এই রোদে ভরসা সানগ্লাস, টুপি ও গ্লুকোজের জল। কিন্তু কর্তব্যে গাফিলতি করার প্রশ্ন নেই। তাপমাত্রা যতই হোক, যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের কাজে সারা দুপুর থাকতে হচ্ছে রাজপথেই।’
চিকিৎসক রুদ্র দেবমল্লিক বললেন, “রোদে যদি বেরোতেই হয়, তবে টুপি-রোদচশমা ব্যবহার করুন। প্রচুর জল খান। ওআরএস খেতে পারেন। চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিন। রোদ থেকে সরাসরি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে ঢুকে পড়বেন না, আগে একটু সইয়ে নিন।”
চাঁদনিচক অঞ্চলের ডাব বিক্রেতা ইসমাইল জানান, গত কয়েক দিনে ডাব বিক্রি বেড়ে গিয়েছে কয়েক গুণ।
কষ্ট হচ্ছে না এই চড়া রোদে দিনভর দাঁড়িয়ে ডাব বিক্রি করতে? এর জবাবে ইসমাইল হেসে বললেন, ‘রুজিরুটির জন্য কষ্ট করা অভ্যাস হয়ে গেছে।’
কষ্টের অভ্যাস একেবারেই নেই যাদের, সেই কচিকাঁচাগুলোকে নিয়েই অভিভাবকেরা চিন্তায় ছিলেন। ওষুধ ব্যবসায়ি তরুণ রুদ্রই যেমন। মঙ্গলবার দুপুরে তিনি আশ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন। তাঁর মেয়ের স্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছে। খুলবে ২৫ তারিখ। তত দিনে তাপপ্রবাহ কমে যাবে বলেই আশা করেন।
এই ঝলসে দেওয়া গরমে সেই আশাই পশ্চিমবঙ্গের ভরসা।