চার আত্মীয়ের ইতালি যাত্রা: সাগরে তিন, তিউনিসিয়ায় এক
2019.05.13
ঢাকা

ইতালি যাবার উদ্দেশ্যে গত ডিসেম্বরে দেশ ছেড়েছিলেন একই পরিবারের চারজন। কিন্তু দালালেরা তাঁদেরকে প্রথমে নিয়ে যায় ভারতে, তারপর লিবিয়ায়। লিবিয়ায় কয়েক মাস প্রায় অনাহারে রেখে, নির্যাতন চালিয়ে দেশে পরিবারের কাছ থেকে এজেন্টরা কয়েক দফায় টাকা আদায় করে।
অবশেষে তাঁদেরকে অবৈধভাবে ইতালি পাঠানোর উদ্দেশ্যে নৌকায় তুলে দেয়। কিন্তু ভূমধ্যসাগরের সেই যাত্রাপথে নৌকা ডুবে মারা যায় তিনজন আর মাত্র একজনকে জীবিত উদ্ধার করতে পারে তিউনিসিয়ার জেলেরা।
সোমবার বেনারের কাছে নিজের চার আত্মীয়ের মর্মান্তিক এই পরিণতির বর্ণনা দেন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কটালপুর এলাকার মুয়িদপুর গ্রামের মফিজুর রহমান।
লিবিয়া থেকে ইতালি প্রবেশের উদ্দেশ্যে অভিবাসী নিয়ে রওয়ানা দেওয়া একটি নৌকা শুক্রবার তিউনিসিয়া উপকূলে ডুবে যায়। নৌকার ৭০-৭৫ জন যাত্রীর মধ্যে ১৬ জনকে স্থানীয় জেলেরা জীবিত উদ্ধার করেন। বাকিদের মধ্যে ৩৭ জন বাংলাদেশি বলে তাৎক্ষণিকভাবে জানায় লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস।
এই নৌকাডুবিতে নিখোঁজদের মধ্যে রয়েছেন মফিজের সহোদর আবদুল আজিজ (২৫), চাচাতো ভাই লিটন আহমেদ (২৪) ও ফুপাতো ভাই আহমেদ হোসেন (২৪)।
আর আট ঘণ্টা পানিতে ভেসে থাকার পর মফিজের চাচা বেলাল আহমেদকে স্থানীয় জেলেরা উদ্ধার করে।
মফিজুল বেনারকে জানান, তাঁর চার আত্মীয় দেশ ছাড়েন গত ১৩ ডিসেম্বর। কথা ছিল ট্রাভেল এজেন্সি তাঁদের সরাসরি ইতালি পাঠাবে। কিন্তু প্রথমে তাঁদেরকে ভারতে পাঠানো হয়। সেখানে ১০-১৫ দিন রেখে নিয়ে যাওয়া হয় লিবিয়ায়।
মফিজুর বলেন, “ইতালি না গিয়ে লিবিয়ায় কেন জানতে চাইলে আমার ভাই জানায়, তারা জানে না।”
তিনি জানান, ওই চারজনকে দুই মাস লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে রাখা হয়। তারপর সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি ক্যাম্পে। গত বৃহস্পতিবার সেখান থেকেই ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তারা।
“ক্যাম্পে তিনমাস তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন করা হয় বলে আমার ভাই জানিয়েছিল। তিন চারদিন পরে এক বেলা খাবার দেওয়া হতো। একটি রুমে ৮০ জনকে রাখা হয়েছিল,” যোগ করেন তিনি।
মফিজুরের অভিযোগ, সেখানে তাঁর ভাইকে জিম্মি করে দালালেরা দুই দফায় মোট আট লাখ টাকা আদায় করেছে।
ওই চারজন সিলেট শহরের ইয়াহিয়া ওভারসিজ এর মাধ্যমে গিয়েছিলেন বলে জানান মফিজুল। ওই ট্রাভেলস এজেন্সির মাধ্যমেই সব টাকা লেনদেন হয়ে বলেও জানান তিনি।
“টাকাটা ইয়াহিয়া ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী এনাম আহমদ চৌধুরীর কাছে দিতাম। আমার ভাইসহ অন্য স্বজনরা তাদের কাছে আটক থাকায় আমরা পুলিশের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করিনি। আমরা ওদের খবর শুনে এনামের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বারবার সবকিছু দেখছেন, খোঁজখবর রাখছেন বলে ফিরিয়ে দেন,” বলেন তিনি।
তবে ঘটনার পর থেকে সিলেট নগরীর ইয়াহিয়া ওভারসিজ বন্ধ রয়েছে, মালিকের মুঠোফোনও বন্ধ।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সিলেটের সভাপতি আবদুল জব্বার জলিল বেনারকে বলেন, “ইয়াহিয়া ওভারসিজ আটাবের সদস্য নয়। সদস্যপ্রাপ্তির জন্য আবেদন করলেও তাদের ব্যবসায় গলদ দেখেই আটাবে তাদের সদস্যপদ দেওয়া হয়নি।”
“সিলেটে কয়েক শ ভুয়া ট্রাভেল এজেন্সি রয়েছে। তারা মানব পাচার করছে। এদের কারণে প্রকৃত ট্রাভেল ব্যবসায়ীরা বিব্রত হচ্ছেন। আমরা বারবার অভিযোগ জানিয়ে আসলেও প্রশাসন নীরব থেকেছে,” যোগ করেন তিনি।
এদিকে সিলেটে সোমবার ট্রাভেল এজেন্সিগুলোতে অভিযান চালিয়েছে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এজেন্ট ব্যবসার আড়ালে মানবপাচারের দায়ে ২৪টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে তারা। এছাড়া আটজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছে।
‘মানবপাচার নেটওয়ার্কের মগজধোলাই’
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) গবেষক ড. জালাল উদ্দিন শিকদার বেনারকে জানান, ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত পাঁচ বছরে ৩২ হাজার ৬২০ বাংলাদেশি সমুদ্র, স্থল ও আকাশ পথে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢুকেছে ভূমধ্যসাগর হয়ে।
অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশকারী বাংলাদেশিদের মধ্যে ২০১৮ সালে ৮৫৮ জন এবং ২০১৭ সালে ৩৫ হাজারের বেশি আটক হয়েছিলেন।
ড. জালাল বলেন, “অবৈধপথে যারা ইউরোপ যাচ্ছেন, তারা শিক্ষিত, পয়সাও আছে। তবুও তারা কেন যাচ্ছে, এটা সরকারকে ভাবতে হবে।”
“সব সময়ই অভিবাসন ছিল। কিন্তু এখন আট-দশ লাখ টাকা দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে মানুষ যাচ্ছে – তারা মানবপাচার নেটওয়ার্কের মগজধোলাইয়ের শিকার,” বলেন তিনি।
উন্নয়ন সংস্থা ব্রাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরীফুল হাসান বলেন, “যারা যাচ্ছে তারা ভাবছে যেকোনো মূল্যে ইউরোপে পৌঁছাতে পারলে অনেক টাকা আয় করা যাবে। ভাগ্য বদলে যাবে। কিন্তু তাদের ধারণা নেই ইউরোপ যেকোনো মূল্যে আনডকুমেন্টেড লোকদের ধরে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই বার্তা তারা জানে না।”
পরিচয় মিলেছে ২৭ বাংলাদেশির
নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজ বাংলাদেশিদের মধ্যে ২৭ জনের পরিচয় মিলেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। একই সঙ্গে পাঁচটি লাশ উদ্ধারের কথাও জানিয়েছে সংস্থাটি।
“তিউনিসিয়া রেড ক্রিসেন্টে প্রাদেশিক প্রধান ডা. মাঙ্গি সিলামের মাধ্যমে জীবিত চার বাংলাদেশির সাথে ফোনালাপের মাধ্যমে পাওয়া তথ্য মতে ২৭ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে,” এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন সোসাইটির পারিবারিক যোগাযোগ পুনঃস্থাপন (আরএফএল) বিভাগের পরিচালক ইমাম জাফর শিকার।
উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের দেওয়া তথ্যমতে, ডুবে যাওয়া নৌকাটিতে মোট ৫১জন বাংলাদেশি ছিলেন। বাকিরা মিশর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক। উদ্ধার হওয়া ১৬ জনের মধ্যে ১৪ জন বাংলাদেশি।
রেড ক্রিসেন্টের তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে সিলেট অঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া ঢাকা নোয়াখালী, শরীয়তপুর ও কিশোরগঞ্জেরও অনেকে রয়েছেন। জীবিতদের মধ্যে ছয়জনের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার চারুগা গ্রামে বলেও জানায় তারা।
তারা এখন তিউনিসিয়ার জারজিস শহরে রয়েছেন। আফ্রিকার উত্তর উপকূলের এই দেশটিতে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস নেই। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সোমবার সেখানে পৌঁছেছেন লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি প্রতিনিধি দল।
দূতাবাসের কাউন্সিলর (শ্রম) আ স ম আশরাফুল ইসলাম বেনারকে জানান, দূতাবাসের পক্ষ হতে তিউনিসিয়ার রেড ক্রিসেন্ট, জাতিসংঘের অভিবাসী বিষয়ক সংস্থাসহ (আইওএম) সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।
রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা যত দূর শুনেছি, ডুবে যাওয়া নৌকায় ৫১ জনের মতো বাংলাদেশি ছিল। তাদের মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ জন মারা গেছেন বলে আমাদের আশঙ্কা।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “অনেক বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ হয়ে লিবিয়া উপকূল থেকে নৌকাযোগে ইউরোপে প্রবেশ করছেন। অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের নিয়ে যাচ্ছে। আর সেখানে যাওয়ার সময় প্রায়ই এমন দুর্ঘটনা ঘটছে।”