বাংলাদেশের অর্ধ লক্ষ নারী যাবেন হংকং
2018.06.08
ঢাকা

সৌদি আরবের পর এবার নারী কর্মী পাঠাতে হংকংয়ের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ সরকার। চুক্তি অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছরে ৫০ হাজার নারী কর্মী গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করতে হংকং যাওয়ার সুযোগ পাবেন। সরকারের ২০১৮-১৯ সালের জেন্ডার বিষয়ক এক প্রতিবেদনে এ কথা জানানো হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপনের সময় জেন্ডার বিষয়ক প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত।
প্রতিবেদনে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অংশে বলা হয়, “আন্তর্জাতিক শ্রম বাজার সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে আগামী পাঁচ বছরে হংকংয়ে ৫০ হাজার নারী কর্মী প্রেরণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে হংকংয়ের সাথে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি হয়েছে। অনুরূপভাবে নারী কর্মী প্রেরণের লক্ষ্যে জর্ডানের সাথেও একটি চুক্তি হয়েছে।”
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে রেকর্ডসংখ্যক ১০ লাখ আট হাজার ৫২৫ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। তাঁদের মধ্যে এক লাখ ২১ হাজার ৯২৫ জন নারী শ্রমিক।
সরকারের হিসেবে, ২০১৩-১৪ সালে বিদেশগামী মোট শ্রমিকের শতকরা ১৭.৮ ভাগ ও পরবর্তী বছরে শতকরা ২১ ভাগ নারী কর্মী ছিলেন। ২০১৫-১৬ অর্থ বছর থেকে তা কমে দাঁড়ায় ১৮.২৯ ভাগ। গত অর্থ বছর নারী কর্মী গমনের হার ১২.৪৩ ভাগে নেমে এসেছে।
অভিবাসী কর্মী সংশ্লিষ্টদের মতে, সৌদি আরব থেকে নারী কর্মীরা নির্যাতিত হয়ে দেশে ফেরার কারণে আগামীতে নারীদের বিদেশ গমন কমে আসার আশঙ্কা রয়েছে।
‘অধিকার নিশ্চিত করতে হবে’
বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও ব্র্যাক এর অভিবাসন শাখার প্রধান শরিফুল হাসান বেনারকে বলেন, “গত প্রায় তিন বছরে সৌদি আরবে প্রায় দুই লাখ নারী শ্রমিক গৃহ পরিচারিকার কাজ করতে গেছেন। তবে সেখানে নারী শ্রমিক পাঠানোর ফলাফল খুব ভালো হয়নি। সেখানে আমাদের নারীরা ভালো নেই।”
ব্র্যাকের ওই কর্মকর্তা জানান, “বাংলাদেশের নারীদের কঠোর পরিশ্রমের কাজ করানো হয়, অনেকে ঠিকমতো বেতন পান না। শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি যৌন নির্যাতনের শিকারও হচ্ছেন অনেকে। সেকারণেই সেখান থেকে আমাদের নারীরা ফিরে আসছেন।”
শরিফুল হাসান জানান, সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশী নারী শ্রমিকদের দেশে ফিরে আসতে সহায়তা করছে ব্র্যাক।
তিনি বলেন, “ফিরে আসা শ্রমিকদের কাছে আমরা যে কথা শুনছি, সেগুলো খুবই কষ্টের। এ বছর জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজারের মতো নারী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন। যারা ফিরে আসছেন তাঁদের কথা অনুযায়ী শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হয় না, শারীরিক নির্যাতন ছাড়াও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাঁরা।”
তবে হংকং এর অভিজ্ঞতা মন্দ নয়। সেখানে আইন কঠোর হওয়ার কারণে নির্যাতনের ঘটনা নেই বললেই চলে, জানান শরিফুল হাসান।
তাঁর মতে, হংকংয়ে যেতে হলে কমপক্ষে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ হওয়ার পাশাপাশি সেখানকার ভাষা জানা বাধ্যতামূলক।
হাসান বলেন, “ইতোমধ্যে সেখানে প্রায় দুই হাজার নারী কর্মী কাজ করছেন। সেখানে একজন নারী শ্রমিক মাসে কমপক্ষে ৭০ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছেন। যদি পরিকল্পিতভাবে আইন অনুযায়ী সেখানে নারী শ্রমিক পাঠানো যায়, তাহলে হংকং আমাদের জন্য বড় শ্রমবাজার হতে পারে।”
অভিবাসন কর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ওয়ারবি ফাউন্ডেশনের প্রধান সৈয়দ সাইফুল হক বেনারকে বলেন, “নারী শ্রমিক পাঠানোর আগে আমাদের অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। সৌদি আরবে আমাদের নারী কর্মীরা ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করছেন। সেখান থেকে আমাদের নারীরা চলে আসতে চাইছেন।”
তিনি বলেন, “সৌদিতে আমাদের সরকারের কোনো নজরদারি নেই। শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘনের কোনো প্রতিকার নেই।”
তাঁর মতে, হংকং ও জর্ডানে নারী শ্রমিক পাঠানোর আগে তাঁদের সঠিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সে দেশের ভাষা জানতে হবে ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। অন্যথায় দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে।
সাইফুল হক বলেন, কর্মী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে আমাদের সরকারের দায়িত্ব হবে অভিবাসী নারী কর্মীদের অধিকার রক্ষার জন্য আইনগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কোনও কর্মীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
তিনি বলেন, “প্রতিকারের ব্যবস্থা না থাকলে আমাদের নারীরা নির্যাতনের শিকার হবেন। সুতরাং, নারী কর্মী পাঠানোর আগে সব বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে।”
সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানো বন্ধ হবে না
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব নমিতা হালদার বেনারকে বলেন, “হংকংয়ে শিক্ষিত মেয়েরা যাচ্ছে। তারা স্থানীয় ক্যান্টনিজ ভাষা জেনে যাচ্ছে। সুতরাং, সেখানে সমস্যা নেই বললেই চলে। কিন্তু সৌদি আরবে সমস্যার কারণ হলো আমাদের মেয়েরা আরবি তো দূরের কথা বাংলাও পড়তে পারে না।”
তিনি বলেন, “সৌদি আরবে কোনো নিয়োগকর্তা নির্যাতন করলে শাস্তির বিধান আছে। থানা পুলিশের কাছে যাওয়ারও ব্যবস্থা আছে। যেহেতু তারা পড়তে পারে না সে কারণে তারা জানে না চুক্তিপত্রে তাদের কী অধিকার দেয়া আছে। আর তাই তারা পালিয়ে সেফ হোমে চলে আসে।”
তিনি বলেন, “বাসা থেকে পালিয়ে সেফ হোমে আসলে বাড়ির মালিক চুরির দায়ে উল্টা মেয়েদের দোষারোপ করে।”
সচিব হালদার বলেন, “আমরা সৌদি আরবে নারী কর্মী প্রেরণ বন্ধ করব না। তবে, নিরক্ষর মেয়েরা যাতে আর ভুয়া প্রশিক্ষণ সনদ নিয়ে সৌদি আরবে কাজে যেতে না পারে সেব্যাপারে আমরা ভবিষ্যতে কঠোর ব্যবস্থা নেব।”