নিখোঁজ এক পরিবারকে ঘিরে আইএস’এ যোগ দানের সন্দেহ
2016.07.19

স্ত্রী–সন্তান নিয়ে ২০১৪ জুলাইয়ে যুক্তরাজ্য ছেড়েছিলেন বাংলাদেশি তথ্য–প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সাইফুল হক সুজন। ওই বছরের ডিসেম্বরের ১০ তারিখে রাকায় মার্কিন বাহিনীর হামলায় নিহত হন তিনি।
বাংলাদেশি একজন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ যুক্তরাজ্যের কেরিয়ার ছেড়ে রাকায় ‘হ্যাকারের’ কাজ কেন নিয়েছিলেন, সেই রহস্য এখনও অজানা।
ঠিক দুই বছরের মাথায় আবারও সপরিবারে সিরিয়া যাওয়ার আরেকটি চাঞ্চল্যকর খবর পাওয়া গেল। এবার দেশ ছেড়েছেন চিকিৎসক–শিক্ষক দম্পতি। প্রায় এক বছর আগে তাঁরা বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে আর ফেরেননি।
তাঁদের সম্পর্কে এখন শোনা যাচ্ছে নানা কথা। কেউ বলছেন, পঞ্চাশোর্ধ শিশু চিকিৎসক খন্দকার রোকনুদ্দিন নিজেই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন জঙ্গিবাদে, আবার কেউ বলছেন তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে থাকতে পারেন।
স্ত্রী, দুই মেয়ে ও মেয়ের জামাই নিয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়া শিশু চিকিৎসক খন্দকার রোকনুদ্দীন সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের ধারণা শিশু চিকিৎসক খন্দকার রোকনুদ্দীন (৫০), তাঁর স্ত্রী নাইমা আক্তার (৪৫), দুই মেয়ে রেজওয়ানা রোকন (২৩) ও রামিতা রোকন (১৫), জামাতা সাদ কায়েসকে (৩০) নিয়ে সিরিয়া গিয়ে থাকতে পারেন।
“তাঁদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার খবর পেয়ে আমরা ডা. রোকনুদ্দিনের খিলগাঁও চৌধুরী পাড়ার ৪২২/বি নং বাসায় গিয়েছিলাম। এটা নিয়ে এখন অনেকগুলো সংস্থা কাজ করছে। খুব শিগগির বিষয়টি আরও পরিস্কার হবে,” বেনারকে জানান রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম।
রামপুরা থানা-পুলিশ আরও জানিয়েছে, খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার যে বাসাটিতে রোকনুদ্দীন সপরিবারে ছিলেন সেটি তাঁর শ্বশুর আলী আহমেদের। আলী আহমেদ দেশের সুপরিচিত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকদের একজন।
খন্দকার রোকনুদ্দীন ঢাকা শিশু হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী নাইমা যশোরের এম এম কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করতেন।
পুলিশ বলছে, এই দম্পতির বড় মেয়ে রেজওয়ানা রোকন ও মেয়ে-জামাই সাদ কায়েস নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ছোট মেয়ে রামিতা রোকন ঢাকায় ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পড়ত।
“রেজওয়ানা ও সাদ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন কি না, সে সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তাঁরা কোন বিভাগে পড়তেন বা আদৌ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন কি না, সে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি,” বেনারকে জানান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা বেলাল আহমেদ।
ডা. রোকনুদ্দীনের বড় ভাই খন্দকার হাফিজ উদ্দিন বেনারকে বলেন, “মাস দুই আগে ফোনে রোকনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সে আমাকে বলেছে, ভালো আছে। ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধাহত সিভিলিয়ান শিশুদের চিকিৎসা দেয় রোকনসহ একটি স্বেচ্ছাসেবক দল। ওই দলে তাঁর মতো অনেক চিকিৎসক আছেন।”
“সিরিয়া ও ইরাকে হামলায় আহত শিশুদের কেউ চিকিৎসা দেয় না। হামলায় ওইসব দেশের মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান। আহতাবস্থায় যেখানে-সেখানে পড়ে থাকে শিশুরা। সেসব শিশুদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায় রোকনসহ তাঁর টিম। তবে কোন দেশে সে অবস্থান করছে, সেটা স্পষ্ট করে বলেনি।” জানান হাফিজউদ্দিন।
ঢাকা শিশু হাসপাতালে দীর্ঘদিন খন্দকার রোকনুদ্দীনের সহকর্মী ছিলেন এমন একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, খন্দকার রোকনুদ্দীন দীর্ঘদিন হাসপাতালের রেজিস্ট্রারের দায়িত্বে ছিলেন। খিলগাঁওয়ে তাঁর ব্যক্তিগত চেম্বারও ছিল জমজমাট। স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি ভালো ছিলেন।
ওই সহকর্মী জানান, তাঁর আচার-আচরণেও কখনো কোনো গোঁড়ামি চোখে পড়েনি। সমস্যার শুরু তাঁর বড় মেয়ের বিয়েকে কেন্দ্র করে। বড় মেয়ে রেজওয়ানা নিজ পছন্দে সাদ কায়েসকে বিয়ে করেন। এ নিয়ে খন্দকার রোকনুদ্দীন অসন্তুষ্ট ছিলেন।
“বিয়ের কিছুদিন আগে থেকে তাঁর মেয়েরা পর্দা করতে শুরু করেন, চলাফেরায় রক্ষণশীল হয়ে ওঠেন। গত বছরের জুলাই-আগস্টে রোকনুদ্দীন চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। তাঁর চেম্বারটি দিয়ে যান মাইকেল রানা নামের এক চিকিৎসককে,” জানান সহকর্মী।
দীর্ঘদিনের সহকর্মী আরও জানান, রোকনুদ্দীন বাড়ি ছাড়ার আগে স্বজনদের জানান যে, তিনি ইউরোপের কয়েকটি দেশে বেড়াতে যাচ্ছেন। সপ্তাহ দুয়েক পর স্বজনদের কলিং কার্ড থেকে ফোন করে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করেন। তিনি জানান, বিদেশে তিনি ‘ইসলামের খেদমত’ করছেন।
চলে যাওয়া নিয়ে একইরকম ভাষ্য পাওয়া গেছে যশোর এম এম কলেজের অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানের কাছ থেকেও। উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক নাইমা আক্তার কলেজ থেকে ৪৬ দিনের ছুটি নিয়েছিলেন। ঢাকা কবি কাজী নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে গত বছরের শুরুতে নাইমা যশোরে বদলি হন।
“উনি হ্বজে যাওয়ার জন্য ছুটি নিয়েছিলেন। কিন্তু ছুটি মঞ্জুর হতে দেরি হওয়ায় আর হ্বজে যেতে পারেননি। পরে কয়েকটি দেশ ঘুরতে যাওয়ার কথা বলেছিলেন,” বেনারকে জানান মিজানুর রহমান।
রোকনের স্ত্রীর বোন ডা. হালিমা সাংবাদিকদের বলেন, “গত এক বছরে তাঁদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে ৩-৪ বার কথা হয়েছে। তাঁরা শুধু বলেছে, একটি মুসলিম দেশে আছে। এ ছাড়া আর কোনো তথ্য জানায়নি।”