প্রশংসা ও সমালোচনার মিশ্রণে সন্ত হলেন মাদার তেরেসা
2016.09.07

গতকাল মঙ্গলবারও কলকাতা জুড়ে মাদার তেরেসার অনুসারি ও ভক্তকূলের মধ্যে সপ্তাহান্তে পাওয়া তাঁর সেইন্ট উপাধি উদযাপনকে ঘিরে ছিল আনন্দঘন পরিবেশ। যদিও সমালোচকেরা ভ্যাটিকান সিটির এই সিগ্ধান্তের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিয়েছেন।
গত রোববার ইতালির সেইন্ট ব্যাসিলিকায় হাজার হাজার পূণ্যার্থীর উপস্থিতিতে শান্তিতে নোবেল জয়ী এই ক্যাথলিক মানবদরদীকে সেইন্ট ঘোষণা করেন পোপ ফ্রান্সিস।
তাঁর সেইন্ট মর্যাদা পাওয়াকে উপলক্ষ্য করে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানি শিলংয়ে মাদার তেরেসার স্মৃতির প্রতি উৎসর্গিত সপ্তাহব্যাপি চলচিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়। বিশ্ব ক্যাথলিক অ্যাসোসিয়েশানের ভারত শাখার আয়োজিত ‘মাদার তেরেসা আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে’ তাঁর জীবনের উপর নির্মিত ২০টি প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচিত্র প্রদর্শিত হবে।
১৯৫০ সালে মাদার তেরেসা কলকাতায় মিশনারিজ অব চ্যারিটি নামে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে দীর্ঘ ৪৫ বছর সমাজের অসহায়, অনাথ, রোগাক্রান্ত ও দুঃস্থ মানুষের সেবা করে গেছেন। ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে মেঘালয় রাজ্যের রাজধানি শিলং থেকে ৫০ কিঃমিঃ দূরে নংপোতে ভারতের প্রথম কুষ্ঠরোগ কেন্দ্রটি স্থাপন করেন। সেই সময় থেকেই সমাজসেবী, অনাথ ও আতুরজনের বন্ধু হিসেবে তাঁর খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
আশোক গোয়েঙ্কা, মেঘালয়ের একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী যিনি ১৯৭৫ সালে শিলং সফরকালে মাদার তেরেসার সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন, তিনি বেনারকে বলেন, “অসুস্থতা স্বত্তেও মাদার ৩২ কিঃমিঃ পদ শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন কুষ্ঠরোগী কেন্দ্রটির তহবিল সংগ্রহের জন্য। সেই কেন্দ্রটি এখন মিশনারিজ অব চ্যারিটি কর্তৃক পরিচালিত একটি পূর্ণবিকশিত চিকিৎসাকেন্দ্র”।
গয়েঙ্কা আরো বলেন, “আমি প্রত্যক্ষভাবে তাঁর চোখে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা অসহায় কুষ্ঠরোগীদের জন্য ব্যথা দেখতে পেয়েছিলাম”।
বিন্দু লানং, একজন সাবেক সাংবাদিক ও পরবর্তীতে রাজনীতিবিদ, যিনি ১৯৭৬ সালে মিশনারিজ অব চ্যারিটির কলকাতার সদর দপ্তরে মাদার তেরেসার সাক্ষাতকার নেন, তিনি বলেন “সেইন্টের একমাত্র লক্ষ্য ছিল অসহায় মানুষদের সাহায্য করা। ৩০ মিনিটের ওই সাক্ষাতকারে তিনি আমাকে আমার লেখার মাধ্যমে মেঘালয়বাসিদের অসহায়-দুঃস্থ মানুষদের নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করার আহ্বান জানাতে বলেন”।
মিশনারি অব চ্যারিটির সেবিকারা তেরেসার সন্ত মর্যাদা লাভে তাঁর জন্য প্রার্থনা করছেন। সেপ্টেম্বর ৪,২০১৬। ছবিঃ কশিটিজ নাগার।
কলকাতায় শ্রদ্ধা ও সমালোচনায় সন্ত হলেন তেরেসা
তেরেসার সন্ত উপাধিতে কলকাতাবাসি যেমন গর্ব করছেন, তেমনি তাঁর সমালোচনাও কিন্তু কম হচ্ছে না। তাঁর সেবার আসল উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে ধর্মান্তরিত করা- এই অভিযোগ যেমন তাঁর জীবদ্দশায় শুনতে হয়েছে, তেমনি আজও সেই সমালোচনা থামেনি।
তাঁকে সেইন্ট স্বীকৃতি প্রদানের ওই অনুষ্ঠানটি সেন্ট পিটার্স স্কয়ার থেকে সরাসরি সম্প্রচার করছিল ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো। সমালোচকদের অনেকেই তখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হ্যাশ ট্যাগের দ্বারা তাঁকে #ফ্রড তেরেসা বলে আখ্যায়িত করেন। তাদের অভিযোগ মানব সেবার নামে তেরেসা অসহায় মানুষদের খ্রিস্ট ধর্মে দিক্ষিত করতেন।
ডাঃ অরূপ চ্যাটার্জি যিনি একাধারে একজন ডাক্তার, লেখক ও মাদার তেরেসার দীর্ঘকালের সমালোচক, তিনি বেনারকে বলেন, “আমি মনেকরি না তিনি সেবার ব্যাপারে খুব একটা যত্নশীল ছিলেন। তিনি ব্যবহৃত সিরিঞ্জগুলো পুনঃব্যবহার করতেন, যা কিনা একটি নীতি বহির্ভূত বিষয়”।
চ্যাটার্জি বলেন, তিনি ইতিমধ্যেই তাঁকে সন্ত ঘোষণার নিন্দা জানিয়ে পোপকে চিঠি লিখেছেন।
প্রয়াত লেখক ক্রিস্টোফার হিচেন্স ২০১২ সালে মাদার তেরেসার ওপর লিখা “ধর্ম প্রচারকের অবস্থানেঃ তত্ত্ব ও চর্চার মধ্যে মাদার তেরেসা” নামক বইয়ে লিখেছিলেন- কিছু ডাক্তার মিশনারি অব চ্যারিটি কর্তৃক পরিচালিত কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শনকালে সেখানে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের ব্যাপক ঘাটতি দেখতে পান।
যদিও তাঁর অনুসারিরা বরাবরই এই দাবী প্রত্যাখ্যান করেন।
মিশনারিজ অব চ্যারিটির একজন স্বেচ্ছাসেবক টিনা কাপুর বেনার নিউজকে বলেন, “আমি অনেক বছর তাঁর সাথে নয়া দিল্লিতে কাজ করেছি। আমি হিন্দু ধর্মের চর্চা করি। আমি কখনোই অনূভব করিনি যে উনি আমাকে আমার ধর্মীয়বিশ্বাস থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। অনেক সময় উনি রোগীদের নাম পর্যন্ত জিজ্ঞাস করতেন না, আর ধর্ম তো বাদই থাকতো”।
মাদারের তিরিশ বছরের সহকর্মী সুনীতা কুমার বেনারকে বলেন, “তিনি ছিলেন ধর্মের অনেক উধ্বে। তাঁর কাউকে ধর্মান্তরিত করার প্রশ্নই ওঠে না। তাঁর সাথে আমার দীর্ঘ কর্মজীবনে কখনোই দেখিনি উনি ধর্মীয়ভাবে কাউকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন। যদি তাই হত তবে গোটা ভারত এতদিনে খ্রিস্টান হয়ে যেত”।
যে কারনে সন্ত হলেন তিনি
তাঁর মৃত্যুর পর দুটি অলৌকিক ঘটনার প্রকাশ পায়, যার প্রেক্ষিতেই তিনি সন্ত ঘোষিত হন।
বলা হয়ে থাকে, ভারতীয় এক নারী জরায়ূমুখে টিউমার থেকে ক্যান্সার আক্রান্ত হন। চিকিৎসকেরা যখন হাল ছেড়ে দিয়েছিল, তখন তিনি মাদার তেরেসার ছবির সামনে প্রার্থনা করতে করতে একদিন সুস্থ হয়ে ওঠেন।
অপর ঘটনাটি ঘটে ব্রাজিলে। ব্রাজিলের এক নারীও দাবী করেন মাদার তেরেসার নামে প্রার্থনা করেই তিনি রোগমুক্তি লাভ করেছেন। যদিও তিনি কখনোই তাঁকে দেখেননি।
মাদার তেরেসা ১৯১০ সালের ২৫ আগস্ট আলবেনিয়ায় জন্ম গ্রহন করেন এবং ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ৮৭ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুকাল অবধি তিনি বিশ্বের ১২৩টি দেশে এইডস, কুষ্ঠ ও যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা কেন্দ্র, অনাথ আশ্রম, শিশু ও পারিবারিক পরামর্শ কেন্দ্র ও বিদ্যালয়সহ মিশনারিজ অব চ্যারিটির ১৬০টি কেন্দ্র রেখে যান।