ভুমিকম্পের ধ্বংশযজ্ঞের মধ্যে নেপালিরা সামলে ওঠার সংগ্রাম করছে
2015.04.27

সারাবিশ্ব থেকে উদ্ধারকারীরা জড় হয়েছে নেপালে, যেখানে প্রবল বৃষ্টিপাত ও ভুমিকম্প পরবর্তি কম্পণ এবং ধ্বংশস্তূপের মধ্যে আটকা পড়েছে হতভাগারা, সেখানে বেঁচে থাকা মানুষদের জন্য ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে।
২ কোটি ৭০ লাখ হিমালয় জাতি রাষ্ট্রের মানুষের আবাসে গত শনিবার আঘাত হানে ৭.৮ মাত্রার ভুমিকম্প।গত দুই দিনে সেখানে মৃত্যু সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩,৪০০। বাড়ছে আরো প্রতিদিন।শক্তিশালী এই ভুমিকম্প আঘাত হানে প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশেও। প্রাণ কেড়েছে ভারতে ৬০ ও বাংলাদেশে ১০ জনের।
উদ্ধারকর্মিরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে পারছে না, রাস্তা-ঘাট অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায়। দালান-কোঠা বা বিধ্বস্ত বাড়ির নীচে আটকা পড়া মানুষদের উদ্ধার করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে, আহতদের নিয়ে যাবার কেউ নেই হাসপাতালে। এরই মধ্যে সোমবার (২৭ এপ্রিল) প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে অসহায় সরকার বাধ্য হয়ে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করে।
প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা রক্তদানের আবেদন জানিয়েছেন এবং বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানান, “দেশের এই ক্রান্তিকালে আমাদের ব্যাপক সাহায্য প্রয়োজন”।
আবহাওয়ার কারণে কাঠমান্ডু বিমান বন্দর আবারো বন্ধ করে দিতে হয়, ফলে আটকাপড়া বিদেশী পর্যটকরা বিমান বন্দরে ঠাশাঠাশি করে অপেক্ষা করছে। নিজ দেশে ফিরতে পারছে না বা সাহায্যবাহী বিমান নামতে পারছে না।
৮০ বছরের মধ্যে সংঘটিত এই ধ্বংশযজ্ঞে শতাধীক দালান ভেঙ্গে পড়েছে, ঐতিহাসিক দারবার স্কোয়ারও রেহাই পায় নি।কাঠমান্ডুর কেন্দ্রে অবস্থিত এই দারবার টাওয়ারটি ইউনেস্কোর ঘোষিত ঐতিহ্যস্থান হিসেবে চিহ্নিত।
এক পুলিশ অফিসার জানায়, ত্রিভূবন বিশ্ববিদ্যালয় হাস্পাতালে তার টিম ১৬৬ জনের মরদেহ পৌছায়।রয়টারকে সুদান শ্রেষ্ঠা বলেন, “ আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, তারপরও কাজ করে যাচ্ছি”।
স্বাস্থ্যকর্মি মানিশ উপধোয়ায় ফোনে বেনার নিউজকে জানান, “ আমি ঘটনার সময় বাড়ির বাইরে ছিলাম, কিন্তু আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা বিধ্বস্ত বাড়ির মধ্যে মারা যায়, সেখানে আমারও মৃত্যু হলে ভালো ছিলো”।বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে সে আরো বলে, “আমি জানিনা ধ্বংশস্তূপ থেকে তাদের দেহ উদ্ধার করা হয়েছে কিনা, আমি আমার সব কিছু হারিয়েছি, আমার জীবন এখন অর্থহীন”।
দূর্গা বাহাদুর(৫০) নেপালের নাওয়েল প্রাশি গ্রামের অধিবাসী যিনি এখন দিল্লিতে বাস করেন, বেনারকে জানান, “আমার গ্রামের ঘর-বাড়ি ধূলায় মিশে গেছে, সেখানে আমার আত্নীয় সহ ২০ জন প্রাণ হারিয়েছে। আমার আর এক আত্নীয় আমাকে ফোনে জানান, আমার বাড়িটিও ধ্বংশ হয়ে গেছে। আমি আমার পরিবার দিল্লিতে আছি বলে আমরা বেঁচে আছি, ঈশ্বরকে সে জন্য ধন্যবাদ”।
এভারেস্ট চূড়ায় আরোহনকারী ১৯ জন বেসক্যাম্পে তুষার ধসে পড়ে মারা গেছে। আহত হয়েছে ৬০ জনের ওপরে। ১৯৩৪ সালের পর এমন দূর্যোগ আর আসেনি। সে সময় ৮,৫০০ পর্বত আরোহীর মৃত্যু হয়।
আহতদের চিকিৎসা এক অসাধ্য ব্যাপার হয়ে উঠেছে। ভুমিকম্প পরবর্তি আফটার শকের ভয়ে অনেক আহত রোগীদের হাস্পাতালের বাইরে রাখতে হয়েছে। ন্যাশনাল ট্রাউমা সেন্টারের সার্জন দীপেন্দ্র পান্ডে রয়টারকে জানান, “যেখানে ১৫ টি অপারেশন থিয়েটার দরকার আমার কাছে মাত্র একটি আছে। শনিবার থেকে আশংকাপূর্ণ ৩৬ জন আহতকে অপারেশন করি। আমাকে অসংখ্য আহতদের চাপের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে”।
ভারতে নিযুক্ত নেপালের রাষ্ট্রদুত দ্বীপকুমার উপাধ্যায় জানান, “ অবস্থা এতই শোচনীয়, হাস্পাতালে মেডিকেল সামগ্রী নিঃশেষ হয়ে গেছে, খোলামেলা জায়গায় আহত রোগীদের চিকিতসা দিতে হচ্ছে, কারণ রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে”।
ভারত নেপালের বৃহত্তম প্রতিবেশী। তারাই সাহায্যের জন্য প্রথম এগিয়ে আসে। ইতিমধ্যে ১৩ টি সামরিক বিমানে তাবু, খাদ্য ও কম্বল নিয়ে পৌছিয়েছে। এরমধ্যে ভারত থেকে বিমানে অষুধ-পত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন “ আমরা উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাবো, যতটা সম্ভব মানুষকে বাঁচানো যায়। অনেকে ধ্বংশস্তূপের নীচে পড়ে আছে তাদের কে উদ্ধার করতেই হবে”।
গ্রেট বৃটেন ৫ মিলিয়ন পাউণ্ড ও ত্রাণকর্মী পাঠিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রাথমিকভাবে ১ মিলিয়ন ডলার মুল্যের সাহায্য দিচ্ছে। দূর্্যোগ প্রতিরোধ কর্মীরা সেখানে গিয়ে প্রয়োজনীয় সাহায্য পরিমাপ করার পর পরবর্তি সাহায্য পাঠাবে বলে জানিয়েছে ইউএসএআইডি।
চীন ৩ মিলিয়ন ৩০ হাজার ডলারের সাহায্য পাঠানোর কথা বলেছে, তাবু, জেনারেটর ও কম্বল পাঠাচ্ছে তারা। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া ১ মিলিয়ন ডলারের সাহাহায্য ও অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড মিলে সাড়ে ৪ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য ঘোষণা করেছে। রাশিয়া ঘোষণা করেছে তারা হেলিকপ্টার ও ড্রোন দিয়ে মেডিক্যাল সাহায্য ও রিলিফ কাজের জন্য পাঠাবে।
বাংলাদেশ, শ্রীলংকা ও পাকিস্তান মেডিক্যাল টিম ও সাহায্য সামগ্রী পাঠাতে শুরু করেছে।
ভুমিকম্পের ব্যপক আঘাত শুধু নেপালে নয় ভারত ও বাংলাদেশেও আঘাত হেনেছে। ভারতে এখন পর্যন্ত ৬২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। যাদের অধিকাংশই বিহারের। আফতার শক আঘাত দিল্লি, উত্তর প্রদেশ ও রাজস্থানেও অনুভূত হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিহতদের পরিবারদের জন্য ক্ষতিপূরন বাবদ ৬ লাখ রুপী করে বরাদ্দের ঘোষণা করেছেন। দেশে কিংবা নেপালে ভারতীয়দের পরিবারদের জিন্য এই সাহায্য দেয়া হবে।
বাংলাদেশে শনিবার ১০ জন নিহত হয়। প্রধানত উচুভবন থেকে সিড়ি বেয়ে নামার সময় পায়ের তলায় পড়ে মারা যায় তারা। ঢাকার উত্তরা থেকে আজিজুর রহমান বেনারকে জানান, “ শনি ও রবি দুই দিন আমি আমার পরিবারের সবাই মিলে বিল্ডিং-এর বাইরে বের হয়ে যাই দালান যখন কাঁপছিল, নেপাল আমদের এত কাছে হয়তো বাংলাদেশেও একদিন এরকম ভুমিকম্প হবে, কিন্তু সরকারকে সেই রকম দূর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে দেখছিনা”।
এদিকে ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজের একটি হলে ফাটল দেখা দেয়ায় হল খালি করে ছাত্রীদের বাড়ি পাঠানো হয়। প্রায় এক হাজার ছাত্রী ঐ হলে থাকেন বলে হল কর্তৃপক্ষ জানায়।
নেপালে অনুর্ধ ১৪ বছরের ফুটবল খেলায় যোগ দিতে গিয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরা। টিমের প্রায় ৩০ জন মেয়ে শনিবারের ভুমিকম্পে আটকা পড়ে। তারা সকলে কাঠমান্ডুর একটি হোটেলে উঠেছিলো। ভুমিকম্পের সময় সবাই বাইরে বেরিয়ে আসে। এরপরও রাতভর তারা আতঙ্কে কাটায়। বিমান বাহিনীর একটি সাহায্য বিমান কাঠমান্ডু থেকে ফিরে আসার সময় সবাইকে রোববার দেশে ফিরিয়ে আনে।
বাংলাদেশ থেকে জেসমিন পাপড়ি এই রিপোর্টে অবদান রেখেছেন।