নারী জাগরণের পথিকৃৎ নূরজাহান বেগমের প্রস্থান
2016.05.23

চলে গেলেন বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে নারীদের প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা বেগম এর সম্পাদক নূরজাহান বেগম। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার ৯১ বছর বয়সে নিভে যায় নারী জাগরণের এই ‘বাতিঘর’।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর পর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয় এই কিংবদন্তি নারীকে। তার আগে বাংলার নারী জাগরণের এই দিকপালের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়েছে গোটা জাতি।
মরহুমার মেয়ে ফ্লোরা নাসরিন বেনারকে বলেন, “মা চেয়েছেন তাঁর বেগম পত্রিকার মশাল যেন কোনো দিন নিভে না যায়। তাঁর সেই চাওয়া অনুযায়ী যেভাবেই হোক বেগম এর প্রকাশনা অব্যহত থাকবে।”
নারী জাগরণের পথিকৃৎ নূরজাহান বেগমের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ৪ মে অসুস্থ্ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর নূরজাহান বেগমের চিকিৎসার ব্যয়ভার নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
নূরজাহান বেগম বাংলার নারীদের রান্নাঘরের বাইরের জগত দেখার অভ্যাস করিয়েছিলেন। তাঁর প্রস্থানের মধ্য দিয়ে একটি অধ্যায়ের শেষ হলো।
উপমহাদেশের নারী জাগরণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ‘বেগম’ পত্রিকার নাম। আর সে নামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত নূরজাহান বেগম। পারিবারিক গন্ডি থেকে চল্লিশের দশকে শুরু করা সেই ‘বেগম’ এখনও আলো ছড়াচ্ছে। পত্রিকাটির মাধ্যমে তিনি সাহিত্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে নারীদের জন্য কথা বলার জায়গা করে দিয়েছিলেন।
নূরজাহান বেগমের পারিবারিক নাম নূরী। তাঁর বাবা মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, যিনি উপমহাদেশের প্রথম পত্রিকা ‘সওগাত’ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি প্রিয় নূরীকে ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির প্রতি আগ্রহী করে তোলেন। জীবদ্দশায় এসব কথা বারবার বলে গেছেন নূরজাহান বেগম।
সমাজের নানা সীমাবদ্ধতা থেকে নারীদের টেনে তুলতে ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই কলকাতা থেকে তাঁর পিতা নাসির উদ্দিন প্রথম প্রকাশ করেন ‘বেগম’ পত্রিকা। দেশ ভাগের পর ১৯৫০ সালে নূরজাহানের সঙ্গে পত্রিকাটিও ঢাকায় আসে।
বেগম পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বেগম সুফিয়া কামাল হলেও কয়েকমাস পর থেকেই নূরজাহান বেগম এটি সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। এরপর থেকে ছয় দশক টানা দায়িত্ব পালন করেন নূরজাহান। আর তাঁর সকল কাজের একটি মাত্র লক্ষ্য ছিল ‘নারী মুক্তি’।
নারী শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯৭ সালে নূরজাহান বেগম রোকেয়া পদক লাভ করেন। এ ছাড়া তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বহু পদক ও সম্মাননা অর্জন করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক সুফিয়া কামালের মেয়ে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বেনারকে বলেন, “আমার মা সুফিয়া কামালের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নূরজাহান বেগম। সাপ্তাহিক বেগমের মাধ্যমে সে সময় নারী লেখিকা ও সাংবাদিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে বাংলার নারীদের জন্য লেখার, আড্ডার, নারীর কাজের পরিবেশ এমনকি নিজেদের নিয়ে ভাবার পরিবেশ তৈরি করেন নূরজাহান বেগম।”
নূর জাহান বেগমের সঙ্গে পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠ সুলতানা বলেন, “চল্লিশের দশকে যখন নারীরা বাইরে বের হত না, তখনকার সময়ে নারী লেখিকাদের ছবি সম্বলিত সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করত বেগম। পত্রিকাটিতে গৃহকর্মের ছবির পাশাপাশি বাইরের বিশ্বের মজার খবরও প্রকাশিত হত। ঘরের নারীরা এর মাধ্যমে পৃথিবী সম্পর্কে ধারনা পেতেন।”
নূরজাহান জীবনভর বেগমকে আঁকড়ে বেঁচে ছিলেন। এটাকে সামনে নিয়ে নারী মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন।
তাঁর সে অবদানের কথা স্মরণ করে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বেনারকে বলেন “নারীমুক্তি আন্দোলনে চিরকালের অনুপ্রেরণা নূরজাহান বেগম। নারীর মর্যাদা ফিরিয়ে আনা এবং তাদের মুক্তি অর্জনে সারাজীবন তিনি কাজ করেছেন। সে মুক্তি শুধু আর্থিক মুক্তি নয়, চিন্তার মুক্তিও।”
সকল নারী মুক্তি আন্দোলনকারীদের জন্য তিনি অনুপ্রেরণা বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুর জেলার চালিতাতলী নামের গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নূরজাহান বেগম। ১৯৪২ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাসের পর ১৯৪৪ সালে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৪৬ সালে একই কলেজ থেকে তিনি বিএ পাস করেন।
কেন্দ্রীয় কচি–কাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা রোকনুজ্জামান খানের (দাদাভাই) সঙ্গে ১৯৫২ সালে বিয়ে হয় নূরজাহানের। ১৯৯৯ সালে স্বামী রোকনুজ্জামান মারা যান।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভানেত্রী আয়েশা খানম বেনারকে বলেন, “বেগম পত্রিকার মাধ্যমে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নারী সমাজকে জাগানোর চেষ্টা করে গেছেন নূরজাহান বেগম। তাঁর দেখানো সেই পথেই বর্তমান ও আগামীর নারীরা চলবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।