সন্ত্রাস ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে নিয়ে একসঙ্গে এগোতে চায় পাকিস্তান
2016.04.08

মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য পাকিস্তান ক্ষমা চাইবে না। বাংলাদেশ তার অতীত ভুলে যাক, এটাও পাকিস্তান চায় না। তবে দেশটি সামনের দিকে তাকানোর পক্ষে, যার মাধ্যমে সন্ত্রাস ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, পারস্পরিক ব্যবসা–বাণিজ্যের বিকাশে একসঙ্গে লড়াই করা যায়।
পাকিস্তান সরকারের একাধিক মন্ত্রী, কূটনীতিক ও বিরোধী রাজনীতিকদের পৃথক পৃথক বক্তব্যে এমন মনোভাব পাওয়া গেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে একে অপরের কূটনীতিককে তলব বা বহিষ্কারের ঘটনায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার রেশ এখনও রয়ে গেছে। জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে এই উত্তেজনা আরেক দফা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মূলত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করায় বাংলাদেশের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের দূরত্ব বেড়েছে। দুই দেশের সম্পর্কে এই টানাপোড়েনের মধ্যে ঢাকার দশ সাংবাদিক পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণে ৪ এপ্রিল থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত দেশটির গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন এলাকা সফর করছেন।
দুই যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করায় পাকিস্তান এর কঠোর সমালোচনা করে, যা নিয়ে কূটনৈতিক বিরোধ চরমে পৌঁছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সেক্টর কমান্ডারস ফোরামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন চায় পাকিস্তান একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুক।
“আমি অতীতকে উপেক্ষা করছি না। অবশ্যই আমাদের অতীতে খারাপ স্মৃতি আছে। তবে আমাদের এখন একসঙ্গে কাজ করতে হবে, সামনে তাকাতে হবে,” পাকিস্তান ক্ষমা চাইবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে এই প্রতিবেদককে একথা বলেন পাকিস্তানের তথ্য মন্ত্রী পারভেজ রশিদ।
ইসলামাবাদে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সফররত বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এ অভিমত ব্যক্ত করেন তথ্যমন্ত্রী।
তথ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশে চার শ বছর দুঃশাসন চালিয়েছে, কিন্তু এখন বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত সবার সঙ্গে দেশটির সুসম্পর্ক রয়েছে। ব্রিটেনের সঙ্গে যদি একত্রে চলতে পারি, তাহলে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সমস্যা কোথায়।
বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের বিরূপ মন্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তথ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি শুধু এই কথাটিই বলব যে, উভয় পক্ষের এমন কিছু করা উচিত হবে না, যা দুই দেশের সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর হবে। আমরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে যেদিন থেকে স্বীকার করে নিয়েছি, ওটাই ছিল দুই দেশের মধ্যে সংহতি প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ।”
বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়ন করতে আগ্রহ
পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা যায়, দেশটি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্কের উন্নয়ন করতে চায়।
“দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের শিথিলতা চলছে, এটা সত্য। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নই পারে দুই দেশের সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে,” জানান সিন্ধু প্রদেশের গভর্নর ড. ইশরাতুল ইবাদ খান।
তাঁর মতে, দুই দেশের বাণিজ্য সংযোগ জোরদার ও একে অপরের বাজার সম্প্রসারণ করা জরুরি।
ড. ইশরাতুল ইবাদ খান ১৩ বছর ধরে গভর্নর পদে বহাল আছেন। তাঁর মতে, দুই দেশের মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে মত পার্থক্য থাকলেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বাণিজ্য সহযোগিতা, বিশেষজ্ঞ বিনিময়সহ নানা ধরনের সহযোগিতার মাধ্যমে এটা দূর করা সম্ভব।
পৃথক বৈঠকে সিন্ধু প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সৈয়দ কায়েম আলী শাহ-ও বলেন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে দুই দেশের বন্ধুত্ব দৃঢ় হতে পারে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ঐতিহাসিক যোগাযোগ রয়েছে। বিশেষত বন্দর নগরী চট্টগ্রাম ও করাচির মধ্যে। এ দুই বন্দরের মাধ্যমে দুই দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধি করা সম্ভব।
“বাণিজ্যিক খরচ পাকিস্তানে বেশ কম। ব্যবসার ব্যয়ও ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে পাকিস্তানে তা অনেক কম। মানবসম্পদের গুনগত মানও এখানে ভাল। তাই ভারতের চেয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা–বাণিজ্যে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে,” জানান সৈয়দ কায়েম।
অন্যতম সমস্যা সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ
পাকিস্তান সন্ত্রাসের চারণভূমি—এমন ধারণা বিশ্বে ছড়িয়ে গেলেও দেশটির নীতিনির্ধারকেরা মত দেন যে, এর বাইরেও দেশটির অনেক পরিচয় আছে।
“সন্ত্রাসবাদ শুধু পাকিস্তান নয়, বিশ্বজুড়ে এটা বড় ধরনের হুমকি। সন্ত্রাসকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিকভাবে মোকাবিলা করতে না পারলে আমাদের সবার জন্যই তা বিপদজনক হয়ে দাঁড়াবে,” সাংবাদিকদের জানান পাকিস্তানের তথ্য সচিব এসএম ইরমান গারদাজি।
নিরাপত্তাকে পাকিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু আখ্যা দিয়ে গভর্নর ইশরাতুল ইবাদ বলেন, “উগ্রবাদ আমাদের জন্য হুমকি হলেও এটা পাকিস্তানি চরিত্রের প্রতিফলন নয়। বেশিরভাগ পাকিস্তানি মধ্যপন্থী। মুসলমানদের চারটি বড় গোত্র এখানে বসবাস করছে। তাদের অন্যতম বিশেষত্ব হল সুফিবাদ। তারা মানবতাবাদী। আর এই বৈশিষ্ট্য দিয়েই উগ্রবাদ মোকাবিলা সম্ভব।”
সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান ইশরাতুল ইবাদ। তিনি বলেন, পাকিস্তানের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। যার ফলে সীমান্ত পথে সন্ত্রাসীদের আনা-গোনা বন্ধ করা বেশ কঠিন।
বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায় পিপিপি
বেনজির ভুট্টোর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী। তারা দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায় বলে মন্তব্য করেছেন দলটির বর্ষীয়ান নেতা ও সিন্ধু প্রদেশের মুখ্য মন্ত্রী সৈয়দ কায়েম আলী শাহ।
বর্তমানে পিপিপি পাকিস্তানের বিরোধী দলে রয়েছে। ক্ষমতাসীন রয়েছে পাকিস্তান মুসলিম লীগ। তবে করাচির মুখ্যমন্ত্রী পদে রয়েছে বিরোধী দলেরই নেতা কায়েম আলী শাহ।
এই সিন্ধু প্রদেশের লারকানা বেনজিরের নিজ এলাকা। আর করাচিতেই বাস করেন বেনজিরের উত্তরাধিকারী বিলওয়াল ভুট্টো। মায়ের মৃত্যুর পর করাচির বিলওয়াল হাউসে বসেই রাজনীতিতে প্রখর দৃষ্টি রাখছেন এই নতুন নেতা।
বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সম্পর্ক নিয়ে আলাপকালে মুখ্যমন্ত্রী কায়েম বলেন, পিপিপি সবসময় বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলে।
করিডর দিতে রাজি পাকিস্তান
বাংলাদেশ যদি পাকিস্তানের ভূখণ্ড ব্যবহার করে আফগানিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে বাণিজ্য করতে চায়, তা দিতে পাকিস্তান রাজি আছে। এ ছাড়া ব্যবসা বৃদ্ধির লক্ষ্যে করাচির বিন কাসিম সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করতে দিতে পাকিস্তানের আপত্তি নেই।
এ ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য জোরদার করার লক্ষ্যে পাকিস্তানের সীমান্ত দিয়ে সিল্ক রোডও ব্যবহারের অনুমতি দিতে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ তাঁর আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।
“তবে এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আসতে হবে,” জানান পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী।
ইরান থেকে পাকিস্তান হয়ে ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন প্রস্তাবের বিষয়ে পাকিস্তানের অবস্থান প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, “পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে আমরা যে কোনো সুবিধা দিতে রাজি আছি।”