কুকুর লেলিয়ে হিমু হত্যায় পাঁচজনের ফাঁসি,পরিবার সন্তুষ্ট
2016.08.15

কুকুর লেলিয়ে শিক্ষার্থী হিমাদ্রী মজুমদার হিমুকে হত্যার দায়ে পাঁচ আসামিরই মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহতের বাবা। উচ্চ আদালতেও এ রায় বহাল থাকবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।
চার বছর আগে ২০১২ সালে মাদক সেবনে বাধা দেওয়ায় কুকুর লেলিয়ে ছাদ থেকে ফেলে হিমুকে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ এলাকার সামারফিল্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে সদ্য এ লেভেল পাস করা হিমুর বয়স তখন মাত্র ১৮ বছর।
বারবার তারিখ পেছানোর পর রোববার (১৪ আগস্ট) হিমু হত্যা মামলার পাঁচ আসামির সবাইকেই সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ডাদেশ দিয়েছে চট্টগ্রামের একটি আদালত।
দণ্ডপ্রাপ্তরা হল; জাহিদুর রহমান শাওন, জুনায়েদ আহমেদ রিয়াদ, তার বাবা শাহ সেলিম টিপু, শাহাদাত হোসেন সাজু ও মাহবুব আলী ড্যানি। মামলার শুরু থেকেই শাওন জামিন নিয়ে এবং রিয়াদ পলাতক রয়েছে। রায়ের সময় টিপু, সাজু ও ড্যানি আদালতে উপস্থিত ছিল।
বিচার নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সন্তান হারানো পিতা প্রবীর মজুমদার।
হিমু হত্যা মামলাটি দেশের অন্যতম চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে বিবেচিত। কুকর লেলিয়ে আহত এবং হত্যার নজিরবিহীন এ ঘটনা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে। আর এ কারণে মামলাটির রায়ের দিকে নজর ছিল সবারই।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অনুপম চক্রবর্তী বেনারকে জানান, “পাঁচ আসামির সকলের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দিয়েছে আদালত।”
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ২০১২ সালের ২৭ এপ্রিল সামারফিল্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে আসামি শাওন, রিয়াদ, সাজু ও ড্যানি হিমুকে ধরে রিয়াদের বাবা ব্যবসায়ী টিপুর বাড়ির ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে আটকে রেখে মারধরের পর হিংস্র কুকুর লেলিয়ে দিয়ে ও ধাক্কা দিয়ে তাঁকে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়। আহত অবস্থায় হাসপাতালে ২৬ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর সে বছরের ২৩ মে হিমু মারা যায়।
নিহতের পরিবার জানায়, স্থানীয় মাদকবিরোধী সংগঠন শিকড়ের সদস্য ছিলেন হিমু। আর মাদক সেবনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল আসামিরা। ২০১১ সালের ২৬ অক্টোবর শিকড়ের পক্ষে স্থানীয় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করাকে কেন্দ্র করে ওই সংগঠন ও এর সদস্যদের সঙ্গে আসামিদের বিরোধের সূত্রপাত হয়। মাদক সেবনে বাধা দেওয়ার ক্ষোভ থেকেই হিমুকে হত্যা করা হয়।
হিমাদ্রী হিমু খুনের ঘটনায় পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা করেন তাঁর মামা শ্রী প্রকাশ দাশ। তদন্ত শেষে ২০১২ সালের ৩০ অক্টোবর পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ।
হিমুর বাবার অভিযোগ, মূলত অভিযোগপত্র দেওয়ার পর থেকে মামলার কালক্ষেপণ শুরু হয়। অভিযোগপত্র দেওয়ার প্রায় দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর পর ২০১৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে পাঁচ আসামির বিচার শুরু করা হয়।
দ্রুত ফাঁসি কার্যকর দেখতে চায় পরিবার
উচ্চ আদালতেও এ রায় বহাল থাকার পাশাপাশি দ্রুত ফাঁসি কার্যকর দেখতে চেয়েছেন হিমুর বাবা প্রবীর মজুমদার ও মা গোপা মজুমদার।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় প্রবীর মজুমদার বেনারকে বলেন, “উচ্চ আদালতে এ রায় বহাল থাকবে বলে আশা করি। এবং পলাতক আসামিদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি কার্যকর করতে হবে।”
মা গোপা মজুমদার বেনারকে বলেন, “হাসপাতালের বিছানায় জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে বারবার বাঁচার জন্য আকুতি করছিল আমার হিমু। আমরা বাবা-মা হিসেবে আমাদের সন্তানকে বাঁচাতে পারিনি। ওর জন্য কিছুই করতে পারিনি। তবে অনেক কষ্ট সয়ে আসামিদের মৃত্যুদণ্ডের রায় আনতে পেরেছি।”
হিমুর বাবা বলেন, বিচার থেকে সরে আসার জন্য আমার ওপর বিভিন্ন ধরনের চাপ ছিল। অনেক লোভও দেখানো হয়েছিল। আসামিদের বাঁচানোর জন্য সমাজের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তির চেষ্টাও ছিল।
ন্যায়বিচার হয়নি দাবি আসামিপক্ষের
নিহতরে পরিবার সন্তোষ জানালেও হিমু হত্যা মামলায় ন্যায় বিচার হয়নি দাবি জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী কফিল উদ্দিন চৌধুরী।
রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপিত যুক্তি যথাযথ ছিল না অভিযোগ এনে বেনারকে তিনি বলেন, “আদালত আমাদের (আসামি পক্ষের) যুক্তিগুলো যথাযথ কনসিডার করেনি। ফলে আমরা ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছি। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করব আমরা।”
তবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এ রায়কে ইতিবাচক বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
হিমু হত্যার রায় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বেনারকে বলেন, “হিমুর বাবা প্রভাবশালীদের নানা চাপের কথা বলেছেন। সে চাপ স্বত্বেও হিমু হত্যার দায়ে পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এটা সমাজের জন্য ইতিবাচক খবর”
“তবে প্রভাবশালীদের চাপে কিংবা আইনের ফাঁক দিয়ে যাতে উচ্চ আদালত থেকে আসামিরা বেরিয়ে যেতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে,” মত দেন সালমা আলী।