গুলশান হামলার পরিকল্পনাকারী কানাডাপ্রবাসী তামিমসহ তিনজন নিহত

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.08.27
160827-BD-truck-1000 জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে তামিম আহমেদ চৌধুরীসহ তিনজন নিহত হওয়ার পর পুলিশ ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। আগস্ট ২৭, ২০১৬।
স্টার মেইল

বহুল আলোচিত জঙ্গি তামিম চৌধুরী অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জ শহরের একটি জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে গুলশান হামলার এই অন্যতম পরিকল্পনাকারীসহ তিনজন নিহত হয়েছে। পুলিশের দাবি, নিহত তামিম (৩০) ‘নব্য জেএমবি’র শীর্ষ নেতা।

তামিম বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) কথিত প্রধান বলে জনশ্রুতি ছিল। কানাডা ও ভারতের গণমাধ্যমে তামিম চৌধুরীকে আইএসের ‘দাবিক’ ম্যাগাজিনের বরাত দিয়ে সংগঠনটির বাংলাদেশ শাখা প্রধান হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

কানাডা প্রবাসী তামিমকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল পুলিশ। সে পলাতক না পুলিশের হেফাজতে—তা নিয়ে গত প্রায় এক মাস ধরে জল্পনা-কল্পনা চলছিল। ঢাকার কানাডার দূতাবাস শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত তামিমের বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেয়নি।

গত ১ জুলাই গুলশান হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত মোট ১৭ জঙ্গি নিহত হলো। গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার ঘটনায় ১৭ বিদেশি, দুই পুলিশসহ ২২ জন নিহত হয়েছিলেন।

১ জুলাই গুলশানের ঘটনায় পাঁচ জঙ্গি, ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের ঘটনায় নয় জঙ্গি এবং সর্বশেষ গতকাল পাইকপাড়ায় তিন জঙ্গি নিহত হয়েছে।  

গতকাল শনিবার সকাল নয়টার দিকে ঢাকা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে পাইকপাড়া কবরস্থানের পাশের একটি তিন তলা বাড়িতে পুলিশের অভিযানে তারা নিহত হয়। পুলিশ এক ঘণ্টার এই অভিযানের নাম দেয় ‘হিট স্ট্রং টোয়েন্টি সেভেন’।

নিহত তামিম চৌধুরী। ছবি: ডিএমপি

অভিযানের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হক ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে সাংবাদিকদের কাছে জঙ্গিনেতা তামিমসহ তিনজন নিহতের খবর নিশ্চিত করেন। তবে তাঁরা নিহত অপর দুজনের নাম প্রকাশ করেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বাংলাদেশ সফরের একদিন আগে পরিচালিত এই অভিযান নিয়েও জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। সোমবার কয়েকঘন্টার সফরে আসছেন কেরি। এসময় দুই দেশের মধ্যে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও নিরাপত্তা ইস্যুতে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক অভিযানস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, গুলশান ও শোলাকিয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী নব্য জেএমবির নেতা।তিনি বলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশ-ডিএমপির সিটি ইউনিট ও সোয়াত টিম এই অভিযান শুরু করে। নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ ও র‍্যাব তাদের সহযোগিতা করে।

সরেজমিন দেখা যায়, নিহত একজন জঙ্গির শরীরে একে ২২ রাইফেল ঝোলানো ছিল। আরেক জন জঙ্গির সঙ্গে একটি পিস্তল ছিল। ফ্ল্যাটের ভেতর কয়েকটি তাজা গ্রেনেড ছিল।

পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হক অভিযানে তামিমসহ তিনজন নিহত হওয়ার তথ্য জানান। ছবি: ফোকাস বাংলা

“পুলিশ জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু তারা পুলিশের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পুলিশের ওপর  গ্রেনেড নিক্ষেপ করে এবং একে ২২ রাইফেলের গুলি ছুড়ে,” সাংবাদিকদের জানান শহীদুল হক।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ও ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. ছানোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “অপারেশনের সময় তামিমের সঙ্গে গ্রেনেড ও তার দুই সহযোগীর একজনের হাতে পয়েন্ট ২২ বোরের পিস্তল ও অন্যজনের হাতে একে ২২ রাইফেল ছিল। তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে ও গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটায়। পুলিশ পরে চারটি গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় করে।”

তিনি জানান, “পুলিশ জঙ্গিদের আস্তানার আশপাশের ভবন থেকে স্নাইপার রাইফেল দিয়ে গুলি ছুড়ে। আমরা আগে নিশ্চিত হয়েছি, সেখানে নারী ও শিশু আছে কিনা।”

কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “অভিযানে তিনজনই নিহত হয়েছেন। কেউ পালিয়ে যায়নি।”

নিহতদের মরদেহ তিনটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হবে।নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন আশুতোষ দাস বেনারকে বলেন, নিহত তিন জঙ্গির ময়নাতদন্তের পাশাপাশি ফরেনসিক টেস্ট এবং ডিএনএ টেস্ট করার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে সেসব সুবিধা না থাকায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে।

তামিম চ্যাপটার শেষ

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘তামিম চৌধুরী চ্যাপটার শেষ হয়েছে।’ গতকাল শনিবার নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় পুলিশের অপারেশন হিট স্ট্রং ২৭ অভিযান শেষে তিনি এই মন্তব্য করেন।

তামিম নিহত হওয়ায় তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হবে কি না এমন প্রশ্নে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, “আমরা হুজুগে কাজ করি না। গোয়েন্দারা সঠিক কাজ করছে।”

অভিযানের বিবরণ

পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বেনার​েকে বলেন, “মূল অভিযানের পরিকল্পনা করতে পুলিশ প্রায় দুই দিন সময় নিয়েছে। শুক্রবার দিবাগত রাত চারটার দিকে প্রথমে এলআইসির সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান।”

তিনি বলেন, “ভোর ছয়টা সাড়ে ছটার দিকে আমরা প্রথমে বাড়ির মালিককে অভিযান সম্পর্কে জানাই। প্রথমে তাঁর মাধ্যমে ও পরে হ্যান্ড মাইকে তাঁদের বাইরে বেরিয়ে আসার অনুরোধ করি। আমরা বলেছি আপনারা আত্মসমর্পণ করুন। আপনাদের সবরকম আইনগত সহায়তা দেওয়া হবে।”

“আমাদের অনুরোধের জবাবে তারা গ্রেনেড ও গুলি ছুড়েছে। অভিযানের সময় তারা ‘নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর’ বলে স্লোগান দিচ্ছিল,” জানান মনিরুল।

বাড়ির মালিকসহ আটক ১০

তিনতলা ওই বাড়ির মালিকের নাম নুরুদ্দীন দেওয়ান। তাঁরা বংশপরম্পরায় পাইকপাড়া এলাকাতেই থাকেন। নুরুদ্দীন দীর্ঘদিন কোরিয়ায় ছিলেন। কোরিয়া থেকে ফিরে তিনি পাইকপাড়ায় ওই বাড়িটি নির্মাণ করেন।

পাইকপাড়ার এই তিনতলা বাড়িতে জঙ্গি দমনে অভিযান চালানো হয়। ছবি: নিউজরুম ফটো।

ওই বাড়িরই দ্বিতীয় তলায় তিনি স্ত্রী ও তিন ছেলেকে নিয়ে বসবাস করছিলেন। তাঁর স্বজনেরা জানান, ঈদের কয়েকদিন আগে মুরাদ ও রানা নাম বলে দুই ব্যক্তি আট হাজার টাকায় ওই বাসাটি ভাড়া নেন। তাঁরা নিজেদের একটি ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তা বলে পরিচয় দিয়েছিলেন।

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন বেনারকে জানান, “জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাড়ির মালিক নুরুদ্দীন দেওয়ানসহ দশজনকে আটক করা হয়েছে।”

নুরুদ্দীনের ভাই সালাউদ্দীন সকাল থেকেই উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। বেনার​েকে তিনি বলেন, “আমরা সাধারণ মানুষ। তামিম চৌধুরী কে, তা কেমনে চিনব”।

পাইকপাড়া বড় কবরস্থানের খাদেম মোহাম্মদ সাইদুর রহমান বলেন, সকাল ৯টা থেকে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় তিনি গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন।

তিনতলা যে বাড়িটিতে জঙ্গিরা ডেরা বেঁধেছিলেন ওই বাড়িটি অন্যান্য বাড়ি থেকে একটু বিচ্ছিন্ন। চারপাশ টিনের বাড়ি দিয়ে ঘেরা। উল্টো পাশে ও রাস্তার দু ’ধারে বেশ কিছু দোকানপাট আছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন কৌশলগত কারণে এ জায়গাটি গুরুত্বপূর্ণ। এই জায়গা থেকে মুন্সিগঞ্জ হয়ে মাওয়া যাওয়া যায়, আবার ঢাকা বা চট্টগ্রামেও যাওয়া যায়। আবার নারায়ণগঞ্জ মডেল থানা ও ফতুল্লা থানার সীমান্তে বাড়িটির অবস্থান হওয়ায় এ জায়গায় পুলিশের নজরদারিও কিছুটা কম ছিল।

কবরস্থানের তিরিশ গজ দূরে একটি চা দোকানে বসে এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। একজন চটপটি বিক্রেতা বলেন, ‘ওই বাড়িটি থেকে লম্বা, ফরসা করে এক লোক দোকানে আসতেন।’  তবে ঠিক তার পাশের দোকানের চা বিক্রেতাকে তামিম চৌধুরীর ছবি দেখালে তিনি চিনতে পারেননি।

ঘনবসতিপূর্ণ পাইকপাড়ায় গতকাল দিনভর মানুষের মধ্যে ছিল ব্যাপক আতঙ্ক। মুদির দোকান ছাড়া বাকি সব দোকানপাটই ছিল বন্ধ। বাড়ির কাছে ছিল উৎসুক জনতার ভিড়।

তামিম দেশে আসেন ২০১৩ সালে

পুলিশ জানায়, ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর তামিম চৌধুরী কানাডা থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছেন। গুলশানের রেস্তোরাঁ হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনার আগে নিশ্চিতভাবে তিনি বাংলাদেশে ছিলেন। গত মঙ্গলবার পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।

ওই সংবাদ সম্মেলনে তামিম চৌধুরী ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক প্রধান ও চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল হককে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।