ভিআইপি থেকে সাধারণ মানুষ, ট্রাফিক আইন মানার প্রবণতা কম
2016.04.22

আর সব দিনের মতোই ২২ মার্চ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রিয়াজ তার সাধের মোটরসাইকেলটি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল। সবকিছুই চলছিল ঠিকঠাক।
কিন্তু রাজধানীর বনানী ২৭ নম্বর সড়কের কাছে এসেই সব শেষ। উল্টো পথে আসা পুলিশের রিকুইজিশন করা বাসের চাপায় প্রাণ হারান তিনি।
এরপর এক মাসও পার হয়নি। একইভাবে উত্তরায় সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় প্রাণ হারালেন আজাদ নামের এক ব্যবসায়ী।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, “দুর্ঘটনা প্রবণ রাজধানীতে উল্টো পথে যানবাহন চলায় সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। ফুটপাতে মোটরসাইকেল ওঠানো বন্ধে আদালতকে নির্দেশনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও আদালতের হস্তক্ষেপ দরকার।”
গত ২৯ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর পুলিশের(ডিএমপি)কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান বলেন, “উল্টো পথে গাড়ি চালানো বন্ধে আমরা গুরুত্বপূর্ণ সড়কে সিসি ক্যামেরা বসিয়েছিলাম। দেখা গেল সম্মানিত অনেক মানুষই উল্টো পথে চলেন।”
আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন,বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ব্যক্তিরা ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করেন। বল প্রয়োগ করেও লোকজনকে পদচারী-সেতু ও আন্ডারপাস ব্যবহারে বাধ্য করা যায় না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও বারবার বলেছেন একই কথা—‘ভিআইপি থেকে সাধারণ মানুষ, অনেকেই ট্রাফিক আইন মানতে চান না।যানজটের এটাও বড় কারণ।’
প্রতিদিন মেয়েকে স্কুলে দিতে যান এমন একজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয়। নাসরিন সুলতানা নামের ওই অভিভাবক বেনারকে বলেন, “ প্রায়ই যানজটের মধ্যে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কে ভেঁপু বাজিয়ে একটি গাড়ি উল্টো পথে যায়। গাড়িটির সামনে কি যেন একটা লোগো বসানো আছে।”
“ভিআইপিরা বিশেষ সুবিধা পান জানি। গাড়িতে অবশ্য একটি স্কুলপড়ুয়া ছেলে বসে থাকে। স্কুলে যাওয়ার পথে এই অগ্রাধিকার ভিআইপি বা তাঁদের স্বজনেরা পান কি না, তা অবশ্য জানা নেই আমার,” জানান নাসরিন।
তবে ঢাকায় ট্রাফিক পুলিশে জয়েন্ট কমিশনার মোসলেহউদ্দীন বেনারকে বলেন, “ভিআইপি বা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো বৈঠকে অংশ নেওয়ার সময় বিশেষ অনুমতি নিয়ে উল্টো পথে যেতে পারেন। এ ছাড়া নয়।”
তবে শুধুমাত্র অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও জীবন রক্ষার্থে প্রয়োজন এমন যানবাহনগুলো উল্টো পথে ভেপু বাজিয়ে যেতে পারে বলে জানান তিনি।
মোটরযান অধ্যাদেশে উল্টো পথে গাড়ি চালানো দণ্ডনীয় অপরাধ। আইনে জরিমানার পরিমাণ খুবই কম, মাত্র ৫০০ টাকা। তবে অপরাধের গুরুত্ব বুঝে গাড়ি চালকের সনদ বাতিল করারও সুযোগ আছে। ট্রাফিক বিভাগ বলছে, নিয়মিত মামলা দেওয়া হয়। তারপরও কাজ হচ্ছে না।
রাস্তায় দায়িত্ব পালন করেন এমন একজন ট্রাফিক পুলিশ বলেন, ব্যক্তিগত গাড়িতে প্রভাবশালী মানুষেরা তাঁদের পেশাগত পরিচিতি ছেপে ইচ্ছে মতো উল্টো পথে গাড়ি চালাচ্ছেন। মোটরসাইকেল ও রিক্সাও পিছিয়ে নেই। প্রত্যেকে চায় সবার আগে গন্তব্যে পৌঁছাতে। তাই যানজটে আটকা পড়লে শিক্ষিত-অশিক্ষিত বহু মানুষ উল্টো পথে চলেন।
মোহাম্মদপুর থেকে ধানমন্ডি, কলাবাগান ও পান্থপথ এলাকায় রিকশা চালান মো. ইসলাম।
লালমাটিয়ায় তিনি নিয়মিত একটি শিশুকে স্কুলে দিয়ে আসা, নিয়ে আসার কাজ করেন। যাওয়ার সময় সোজা পথে গেলেও ফেরার পথে ঠিকই উল্টো পথে আসেন। কেন উল্টো পথে আসেন?
এমন প্রশ্নের জবাবে বেনারকে তিনি বলেন, “রাস্তা অল্পই। জট না থাকলে উল্টো যাই। জোরে বেল বাজাই। আর যদি আনসার বা কমিউনিটি পুলিশ ধরে তাহলে ১০ টাকা বা ৫ টাকা দেই। কিছু কয় না।”
২০১৪ সালে একদফা বাংলাদেশ পুলিশ রাস্তায় বিশেষ ধরনের কাঁটা বসিয়েছিল। উল্টো পথে এলেই এতে গাড়ির চাকা ফুটো হয়ে যাওয়ার কথা। আর সোজা পথে গেলে কাঁটাগুলোর মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার কথা।
সে যাত্রায় এ উদ্যোগ স্থায়ী হয়েছিল মাত্র তিনদিন। তিনদিনের মাথায় কাঁটা আপনাআপনি উঠে আসতে শুরু করে।
বাংলাদেশ অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবদুল গণি মোল্লা বেনারকে বলেন, “সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কারণে গোটা পরিবার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। পঙ্গুত্বের কারণেও পুরো পরিবার পথে বসে যেতে পারে। তাই যে করেই হোক অন্যান্য ট্রাফিক আইন মানার মতো উল্টো পথে গাড়ি না চালানোর বিধি-নিষেধও মানতে হবে।”
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রভাবশালীদের আগে এগিয়ে আসতে হবে। তাঁদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, তাঁরা উল্টো পথে গাড়ি চালাবেন না। সেই সঙ্গে পুলিশকেও তার তৎপরতা বাড়াতে হবে। চালকের লাইসেন্স বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে এই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে।