দীর্ঘতম উড়ালপুলে মারাত্মক যানজট, হাঁসফাঁস করছে কলকাতা

গত শুক্রবার কলকাতায় খুলে দেওয়া হল শহরের দীর্ঘতম উড়ালপুল। উদ্বোধনের দিন থেকেই বিপুল যানজট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গলদ ছিল পরিকল্পনায়। শহরবাসী বিরক্ত, উদ্বিগ্ন পুলিশ।
কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2015.10.13
WB-flyover কলকাতা শহরের দীর্ঘতম উড়ালপুল। অক্টোবর,২০১৫
অনলাইন

কলকাতায় মায়ের অবস্থা শোচনীয়!

এই অবধি পড়েই আঁতকে উঠবেন না। কারও মায়ের অসুস্থতার সংবাদ নয়। এমনকী, আর দিনকয়েকের মধ্যেই যাঁর পূজায় গোটা শহর মেতে উঠবে, সেই মা দুর্গা বিষয়েও কথা হচ্ছে না। ‘মা’ আসলে কলকাতার নতুনতম উড়ালপুলের নাম।

ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস থেকে পার্ক সার্কাস মোড় অবধি প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার দীর্ঘ এই উড়ালপুলটি পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘতম। কলকাতা পুরসভা থেকে তার নামই রাখা হয়েছে ‘মা’। হঠাৎ এমন নামকরণ কেন, তা নিয়ে রহস্য এখনও কাটেনি। মা দুর্গার আরাধনার ঠিক আগেই উদ্বোধন হল বলে ‘মা’, না কি এই ‘মা’ আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক স্লোগান “মা-মাটি-মানুষ”-এর ‘মা’, জল্পনা চলছে। দাঁড়িপাল্লা যে দ্বিতীয় সম্ভাবনার দিকেই ঝুঁকে, সন্দেহ নেই।

এই মায়ের অবস্থাই শোচনীয়।

গত শুক্রবার, ভুটান সফর সেরে ফেরার পথে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্বোধন করেন এই উড়ালপুলের। বলেন, বাইপাস থেকে পার্ক সার্কাস অবধি রাস্তায় যানবাহনের গতি অনেক বাড়াবে এই উড়ালপুল। পার্ক সার্কাস থেকে বিমানবন্দর যেতে চান, বা উল্টো অভিমুখে সায়েন্স সিটি থেকে হাওড়া, পৌঁছে যাওয়া যাবে নিমেষে।

উদ্বোধনের পরেই ভেসে এল একটা টুইট। খ্যাতনামা সাংবাদিক সুপর্ণ পাঠকের। তিনি লিখলেন, পারতপক্ষে নতুন উড়ালপুলের দিকে যাবেন না। মারাত্মক যানজট। আরও ঘণ্টাখানেক পরে জানালেন, যেখানে ছিলেন, তাঁর গাড়ি কার্যত সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ট্র্যাফিক নড়ছেই না। একই অভিজ্ঞতা বিজ্ঞাপনকর্মী পরমা মুখোপাধ্যায়েরও। উড়ালপুল আর তাঁর নাম এক, এমন মজার সমাপতন উপভোগ করতে উদ্বোধনের দিনই উড়ালপুলে নিজের গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। পরমা বেনার নিউজকে বললেন, ‘জ্যামে জেলি হয়ে গেলাম! প্রথম দিনই এমন মারাত্মক ট্র্যাফিক জ্যাম হবে, ভাবতেই পারিনি। কী আশ্চর্য, জ্যাম কমানোর জন্যই তো উড়ালপুল। তার ওপরেই এত যানজট!’

এমন অবস্থা কেন? বিশেষজ্ঞরা এক কথায় বলছেন, পরিকল্পনার অভাবেই এমন কাণ্ড ঘটল। কলকাতা পুলিশের সূত্র বলছে, “পার্ক সার্কাসে যেখানে এসে উড়ালপুল মাটিতে নেমেছে, সেখানে রাস্তার প্রস্থ উড়ালপুলের প্রস্থের তুলনায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কম। ফলে, উড়ালপুলের ওপর যেখানে চারটে গাড়ি পাশাপাশি চলছিল, সেখানে রাস্তায় নামার পর পাশাপাশি দুটো গাড়িও ঠিক ভাবে চলতে পারছে না।“ অতএব, সুদীর্ঘ যানজট তৈরি হচ্ছে এবং সাড়ে চার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে তার প্রভাব পড়ছে উড়ালপুলের অন্য প্রান্তেও।

পরিস্থিতি কতখানি সঙ্গীন? এতটাই যে উড়ালপুল চালু হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। ঘণ্টাদুয়েক বন্ধ রাখার পর উড়ালপুল খুলে দিলে ফের চাপ বাড়ে। বেশ কয়েক দফায় উড়ালপুল বন্ধ রাখা হয়। শনিবারও ছবিটা একই ছিল। শেষ পর্যন্ত শনিবার রাতে কলকাতা পুলিশের কর্তারা সিদ্ধান্ত করেন যে আপাতত দ্বিমুখী নয়, উড়ালপুল খোলা থাকবে একমুখী পথে। অর্থাৎ, পরমা আইল্যান্ড থেকে পার্ক সার্কাসের দিকে যাওয়া যাবে, কিন্তু উল্টো অভিমুখে যাওয়া নিষিদ্ধ থাকবে।

তা হলে এটাই কি সমাধান? কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটির চিফ ইঞ্জিনিয়র দেবাশিস মান্না স্বীকার করলেন, সমস্যা এড়ানোর বহু সম্ভাব্য পথ নিয়ে তাঁরা আলোচনা করেছেন বটে, কিন্তু কোনও স্থায়ী সমাধানসূত্রে এখনও পৌঁছোতে পারেননি। তা হলে কি বলা যেতে পারে যে সব দিক খতিয়ে না দেখেই সরকার তড়িঘড়ি উড়ালপুল চালু করার সিদ্ধান্ত করল? উত্তরে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি ছাড়া কোনও কর্তার কাছেই কোনও উত্তর মিলল না।

তাতে অবশ্য প্রশ্নের ঝড় থামছে না। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায়ী অভিষেক গুপ্ত বেনার নিউজকে বললেন, “উড়ালপুলকে একমুখী করে রেখে যানজট সামলানো তো কোনও সমাধান নয়। এটা জোড়াতালি দেওয়া ব্যবস্থা। ভেবে দেখুন, এই উড়ালপুল তো এক দিন সকালে হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েনি। দীর্ঘ চার-পাঁচ বছর ধরে তৈরি হয়েছে। এত দিনেও ভারপ্রাপ্ত দফতরগুলি এই সমস্যা আঁচ করতে পারেনি? তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে পারেনি? পরিকাঠামোর এমনই হাঁড়ির হাল!”

স্থপতি ও নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ নীলাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায় বেনার নিউজকে বললেন, “সমস্যার একমাত্র সমাধান পার্ক সার্কাসের দিকে দুটো রাম্প তৈরি করা। এই সমস্যা যে হবে, সেটা আগেই আঁচ করা উচিত ছিল। ওই রাম্প তৈরি না করে উড়ালপুল খুলে দেওয়া ঠিক হয়নি। যত দিন রাম্প তৈরি না হচ্ছে, তত ক্ষণ একমুখী গাড়ি চালানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।“

তবে, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। কলকাতা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তৈরি হচ্ছে আরও বেশ কয়েকটি উড়ালপুল। বজবজ-জিঞ্জিরাবাজার উড়ালপুল তার মধ্যে অন্যতম। প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার দীর্ঘ এই উড়ালপুলের দৈর্ঘ্য আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত করেছে কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি। সংস্থার মতে, এ পথে হাঁটলে যানজট এড়ানো সম্ভব হবে।

পরমা উড়ালপুলের সমস্যা অবশ্য কাটছে না। উড়ালপুলটিকে একমুখী করে দেওয়ার পুলিশি সিদ্ধান্তে অখুশি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোমবার বিকেলে সশরীরে উড়ালপুল পরিদর্শনে চলে আসেন। সঙ্গী কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ সহ উচ্চপদস্থ কর্তারা। খানিক গাড়িতে, খানিক পায়ে হেঁটে উড়ালপুল পরিদর্শনের পর মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকর্তাদের কাছে জানতে চান, কেন একমুখী করে দেওয়া হল উড়ালপুলটিকে? কর্তাদের যুক্তিতে মোটেও সন্তুষ্ট হননি মুখ্যমন্ত্রী। বললেন, মানুষের সুবিধার জন্য দ্বিমুখী গাড়ি চালাতে হবে।

উচ্চবাচ্য না করেই পুলিশকর্তারা মুখ্যমন্ত্রীর কথা মেনে নেন। নিজেদের অভিজ্ঞতা এবং কাণ্ডজ্ঞান, অথবা নগর পরিকল্পকদের মতামত, কোনওটারই তোয়াক্কা না করে ফের দ্বিমুখী গাড়ি চালানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এবং, উড়ালপুলের ওপর তৈরি হয় দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যাম।

পার্ক সার্কাস মোড়ে ট্রাফিকের চাপ সামলাতে হাবুডুবু খাওয়া এক সার্জেন্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন, মুখ্যমন্ত্রী তো হুকুম করেই খালাস। আমাদের কর্তারাও বিনা প্রশ্নে সব মেনে নিলেন। এই ট্রাফিক সামলাবে কে? পার্ক সার্কাস মোড়ের চার পাশে অন্তত গোটা বারো স্কুল আছে, হাসপাতাল রয়েছে। এই ট্রাফিক জ্যাম চললে ছাত্রছাত্রী অথবা রোগীদের কী হবে, ভেবে দেখেছেন?

না ভেবে উপায় নেই কলকাতার। যানজটের শাপমুক্তির জন্য তৈরি হল যে উড়ালপুল, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে যানজটের সবচেয়ে বড় কারণ। দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে!

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।