৭ দশক পরে নেতাজি সংক্রান্ত নথি প্রকাশ হবে, রহস্যের জট খুলবে কি?

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2015.10.16
WB-netaji আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯৪০ সালের একটি ছবি।
অনলাইন

তাঁর অন্তর্ধানের পর পেরিয়ে গিয়েছে সাত দশক। ১৯৪৫ সালের পর তাঁর আর কোনও খবর পাওয়া যায়নি। তবুও, এখনও আসমুদ্রহিমাচল ভারত উদ্বেল হয় তাঁর নামে। এখনও অনেকেই বিশ্বাস করেন, বিমান দুর্ঘটনায় তিনি মারা যেতে পারেন না। মাঝেমধ্যেই গুজব রটে, তাঁকে দেখা গিয়েছে। কিন্তু কখনও সেই গুজবের সত্যতা প্রমাণিত হয় না। অভিযোগ ওঠে, তাঁর অন্তর্ধানের পরেও জওহরলাল নেহরুর সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ কড়া নজরদারি চালাত তাঁর পরিবারের ওপর। সেই অভিযোগকে কেন্দ্র করে রাজনীতির জলও ঘোলা হয়।

তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। পরাধীন ভারতের রাজনীতির উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের এক জন। এবং, তাঁকে ঘিরেই মানুষের জল্পনার জাল নিঃসন্দেহে দীর্ঘতম। সেই জল্পনার একটি কারণ যদি হয় তাঁর রহস্যজনক অন্তর্ধান, অন্য কারণটি হল, নেতাজি সংক্রান্ত যে কোনও নথি প্রকাশেই সরকারের তীব্র অনীহা। স্বাধীনতা অর্জনের পর কেটে গিয়েছে দীর্ঘ ৬৮ বছর। কিন্তু, না কেন্দ্রীয় সরকার, না পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার, কেউই নেতাজি সংক্রান্ত কোনও নথি প্রকাশে রাজি হয়নি। কী আছে সেই নথিতে, জানা সম্ভব হয়নি। এবং, তাতেই মানুষের মনে সন্দেহ প্রকটতর হয়েছে।

গত সেপ্টেম্বরে প্রথম ব্যতিক্রমী হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রকাশ করেছিলেন রাজ্য সরকারের হেফাজতে থাকা মোট ৬৪টি নথি। বারো হাজারেরও বেশি পৃষ্ঠা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সেই নথিকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা করেন তিনি। নথি সম্বলিত ডিভিডি তুলে দেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাতে। এবং দাবি তোলেন, কেন্দ্রীয় সরকারেরও উচিত তাদের হাতে থাকা নথি জনসমক্ষে আনা।

বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেই ঘোষণাই করলেন। জানালেন, ২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি, নেতাজি জয়ন্তীর দিন, কেন্দ্রীয় সরকার প্রথম দফা নেতাজি নথি প্রকাশ করবে। হিসেব বলছে, বর্তমানে নেতাজি সংক্রান্ত অন্তত ১৪৩টি ফাইল রয়েছে কেন্দ্রের কাছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে রয়েছে ৩৯টি (ছিল মোট ৪১টি, যার মধ্যে দু’টি গত বছর প্রকাশ করে দেওয়া হয়), বিদেশ মন্ত্রকে রয়েছে ২৭টি, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর হেফাজতে রয়েছে ৭৭টি। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে আছে প্রায় ৬০ হাজার পাতার নথি। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে এখনও যে ফাইলগুলি রয়েছে, তার মধ্যে ‘টপ সিক্রেট’ ৪টি, ‘সিক্রেট’ ২০টি, ‘ক্লাসিফায়েড’ ৫টি, ‘আনক্লাসিফায়েড’ ১০টি। এর মধ্যে কোন ফাইলগুলি প্রথম ধাপে প্রকাশ্যে আনা হবে, তা অবশ্য স্পষ্ট করেননি মোদী।

তবে, বিজেপি-র সর্বভারতীয় মুখপাত্র সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বললেন, ‘আগামী ২৩ জানুয়ারি থেকে ভারতীয় রাজনীতির স্রোত বদলে যাবে। অপ্রকাশিত নেতাজি নথিতে এমনই সব তথ্য রয়েছে।’ বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাসভবনে, তাঁরই আমন্ত্রণে, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে উপস্থিত হয়েছিলেন নেতাজির পরিবারের ৩৫ জন সদস্য। তাঁদের সঙ্গে বৈঠকের পরে টুইটারে মোদী লিখেছেন, ‘ইতিহাসের কণ্ঠরোধ করার কোনও প্রয়োজন নেই। যে দেশ ইতিহাসকে ভুলে যায়, তার ইতিহাস গড়ার ক্ষমতা নেই।’ ইঙ্গিত, স্পষ্টতই, কংগ্রেসের দিকে।

সূত্রের খবর, অন্য যে ছ’টি দেশে নেতাজি সংক্রান্ত গোপন নথি রয়েছে, সেগুলিও প্রকাশ্যে আনার জন্য তিনি ব্যক্তিগত ভাবে তৎপর হবেন বলে আজ বসু পরিবারের সদস্যদের আশ্বস্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনার পর নেতাজি রাশিয়ায় ছিলেন বলেও বিভিন্ন সময়ে দাবি উঠেছে। আগামী ডিসেম্বরেই রাশিয়া সফরে যাচ্ছেন মোদী। টুইটারে তিনি লিখেছেন, রুশ সরকারকেও তিনি এই ব্যাপারে অনুরোধ করবেন।

কী আছে নেতাজি ফাইলে, যে তথ্য প্রকাশ করতে সব রাজনৈতিক দলেরই এত দীর্ঘ দিন ধরে প্রবল অনীহা ছিল? পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেপ্টেম্বর মাসে নথি প্রকাশ করার পর কৌতূহলীরা জানতে উদগ্রীব হয়েছিলেন। তাঁরা অবশ্য হতাশ। নথি দেখার পর নেতাজির ভ্রাতুষ্পুত্রবধূ কৃষ্ণা বসু বলেছিলেন, ‘লোকের মনে যে পরিমাণ প্রত্যাশা জাগানো হয়েছিল যে তিনি বিমান দুর্ঘটনার পর সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছেন বা রাশিয়া চলে গিয়েছেন, সে সংক্রান্ত তথ্য এই নথিতে থাকবে, তেমনটা কিছুই নেই।’ হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইতিহাসবিদ সুগত বসু, নেতাজির সবচেয়ে প্রামাণ্য জীবনী ‘হিজ ম্যাজেস্টিজ এনিমি’-র লেখক, বললেন, ‘নথি থেকে জোরালো কিছু পাওয়ার কথাও ছিল না। দু’একটা ফাইলে কিছু জল্পনা আছে। যুদ্ধের সময় পুলিশ রিপোর্টে এ সব জল্পনা, গুজব ইত্যাদির উল্লেখ থাকেই।’

অবশ্য, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেফাজতে থাকা নথি যে তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ, সে কথা ওয়াকিবহাল মহলে প্রত্যেকেই বলছেন। বিশেষত, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও নেতাজির পরিবারের ওপর কী ধরনের নজরদারি চলেছিল, সে সংক্রান্ত তথ্য থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হেফাজতেই, কারণ নজরদারির দায়িত্বে ছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ বা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো। গত বছর এক ব্রিটিশ সংবাদপত্র দাবি করেছিল, সেই নজরদারি বিষয়ে গোপন তথ্য তাদের হাতে এসেছে। সেই তথ্য নাকি বলছে, প্রধানমন্ত্রী নেহরুর নির্দেশেই নেতাজির দুই ভ্রাতুষ্পুত্রের প্রাত্যহিক চলাফেরার ওপরও নজরদারি হত। অনেকেরই অনুমান, কেন্দ্রীয় সরকার নথি প্রকাশ করলে এমন আরও অনেক খবর জনসমক্ষে আসবে।

দিল্লির অশোকা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য, ইতিহাসবিদ রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়ের মতে, এই জল্পনা সম্ভবত ভিত্তিহীন। কারণ, ব্যক্তি জওহরলাল নেহরু সম্বন্ধে এত দিন যত কথা জানা গিয়েছে, তার প্রায় প্রতিটিই বিপরীত দিকে নির্দেশ করে। বলে যে এই তুচ্ছতার মধ্যে ঢোকার লোক তিনি ছিলেন না। তবে, নজরদারির সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না অন্যান্য অনেক ইতিহাসবিদ। বলছেন, নেহরুর প্রত্যক্ষ নির্দেশ না থাকলেও নজরদারি হতেই পারে। কারণ, ভারতীয় নেতাদের ওপর গোয়েন্দা বিভাগের নজরদারির ঐতিহ্যটি ঔপনিবেশিক আমলের। দেশ স্বাধীন হলেও পুরনো অভ্যেস ছাড়তে সময় লাগে।

নেতাজি-উৎসাহীরা তাকিয়ে রয়েছেন ২৩ জানুয়ারির দিকে। ইতিহাসবিদ শ্যামল সেনগুপ্ত কিন্তু হতাশ করলেন। বললেন, ‘নথি নিয়ে এই উৎসাহ বহুলাংশেই অর্থহীন। ইতিহাসের নথি পড়ার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। যে কোনও তথ্য বহু দিক থেকে বিচার করা প্রয়োজন, ক্রস রেফারেন্স দেখা প্রয়োজন। এক জন সাধারণ মানুষ যদি ভাবেন, নেতাজি নথি হাতে পেলেই তিনিও সব রহস্যের সমাধান করতে পারবেন, তা হলে তিনি ভুল ভাবছেন।’

তবে, একই সঙ্গে তিনি যোগ করলেন, ‘নথি নিয়ে এত দিনের অনর্থক গোপনীয়তাই এত রকম জল্পনার জন্ম দিয়েছে। অনেক আগেই সব নথি প্রকাশ করে দেওয়া উচিত ছিল।’

একই কথা বললেন নেতাজির কন্যা অনিতা বসু পাফ। ভিয়েনা থেকে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘দেরিতে হলেও যে এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া গিয়েছে, সেটাই ভাল। সত্তর বছর আগে কী হয়েছিল, তার জন্য এখনকার সরকারকে কেউ যে দোষ দেবে না, এটা সকলের বোঝা উচিত।’

আর তিন মাস অপেক্ষা। তার পরই মিলবে সব প্রশ্নের উত্তর।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।