পুর-নির্বাচনে তুমুল সন্ত্রাস, সাংবাদিক লাঞ্চিত পশ্চিমবঙ্গে
2015.10.05

একটা গোটা নির্বাচনের ভোটগণনার কাজ স্থগিত করে দিল নির্বাচন কমিশন, জানাল যে বেশ কিছু বুথে পুনর্নির্বাচনের পরই ভোটগণনা হবে— সাম্প্রতিক অতীতে শুধু পশ্চিমবঙ্গে কেন, গোটা দেশেই এমন ঘটনা নজিরবিহীন। এমন বিরল সিদ্ধান্ত গ্রহণেই বাধ্য হলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়।
তিনি জানালেন, শনিবার রাজ্যের যে পুর-নিগমগুলির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার মধ্যে শুধু শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের ভোটগণনাই হবে নির্ধারিত দিন, অর্থাৎ বুধবার। বিধাননগর-রাজারহাট পুরনিগম, বালি পুরসভা এবং আসানসোল পুরসভার বেশ কয়েকটি বুথে বৃহস্পতিবার পুনর্নির্বাচন হবে, এবং ভোটগণনা হবে শুক্রবার।
কেন নির্বাচন কমিশনকে এমন কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হল? শনিবার যে যে এলাকাতেই নির্বাচন ছিল, সেখানেই সকাল থেকে ছিল প্রত্যক্ষ সন্ত্রাস। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের গুণ্ডাবাহিনী দাপিয়ে বেড়াল বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। একেবারে ভোট-বুথের সামনে দাঁড়িয়ে রইল শাসক দলের বাহুবলী।
বিধাননগর-রাজারহাট পুরনিগমের ভোটার, পেশায় সাংবাদিক রত্নাঙ্ক ভট্টাচার্য বললেন, “ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে এক অচেনা যুবক আমায় তৃণমূল কংগ্রেসের চিহ্ন দেখিয়ে বলল, এই বোতামটা টিপুন। এই অবস্থায় অন্য কোনও প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার মতো সাহস ছিল না আমার।” বিধাননগরেই নির্বাচনী বুথে বহিরাগত যুবকের উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় সাতসকালেই প্রহৃত হলেন ৬৭ বছরের বৃদ্ধ প্রীতিকুমার সেন।
পুলিশ সর্বত্রই নিছক দর্শকের ভূমিকায় ছিল। বালি পুরসভার লিলুয়া কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী যশবন্ত সিংহ বললেন, “সকাল থেকেই বহিরাগতদের দিয়ে রিগিং এবং ছাপ্পা চলেছে। নির্বাচন কমিশন ও পুলিশকে বলেও কোনও লাভ হয়নি।” আসানসোলেও একই ছবি। কোমরে পিস্তল গুঁজে সকাল থেকে দাপিয়ে বেরিয়েছে বহিরাগত বাহুবলীরা। বুথ দখল, বিরোধী প্রার্থীর পোলিং এজেন্টকে মারধোর, বাদ যায়নি কিছুই। মার খেয়েছেন বেশ কয়েক জন প্রার্থীও। এখানেও পুলিশ একেবারে নিষ্ক্রিয় ছিল বলেই অভিযোগ।
আক্রমন সাংবাদিকদের ওপর
নির্বাচনী অশান্তির এই ছবিটা যদি চেনা হয়ও, যেটা একেবারে নতুন, তা হল সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ। যে সংবাদমাধ্যমগুলি একেবারে শাসকদের পেটোয়া হিসেবে পরিচিত, রেহাই মিলেছে শুধু তাদের সাংবাদিকদের।
বিধাননগর-রাজারহাট অঞ্চলে মার খেয়েছেন আনন্দবাজার পত্রিকা, এবিপি আনন্দ, দ্য টেলিগ্রাফ, কলকাতা টিভি, ২৪ ঘণ্টা সহ বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের মোট ১৭ জন সাংবাদিক। নিগ্রহ থেকে বাদ পড়েননি মহিলা সাংবাদিকরাও। আক্রান্তদের কয়েক জনের আঘাত গুরুতর, তাঁরা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। বালি এবং আসানসোলেও সাংবাদিকদের ক্যামেরা কেড়ে নেওয়া, হুমকি দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে।
সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে শাসক দলের অন্তত তিন জন বিধায়কের নাম। তাঁরা সুজিত বসু, পরেশ পাল এবং অর্জুন সিংহ। টেলিভিশনের ফুটেজে দেখা গিয়েছে, সরাসরি আক্রমণ পরিচালনা করছেন তাঁরা। দেখা গিয়েছে, সারা দিনই তাঁদের নেতৃত্বে সন্ত্রাস চালিয়েছে গুণ্ডাবাহিনী।
নির্বাচনী সন্ত্রাস এবং সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে কলকাতার নাগরিক সমাজ। কবি শঙ্খ ঘোষ বললেন, “নির্লজ্জ বর্বরতা তার শেষ সীমা ছাড়িয়েছে।” সমাজতত্ত্ববিদ আন্দ্রে বেতেই বললেন, “এ ভাবে সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করা যায় না।” সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “অত্যন্ত লজ্জা ও বেদনার ঘটনা। সাংবাদিকদের প্রতি আমার পূর্ণ সহমর্মিতা আছে।”
নির্বাচনে অবাধ সন্ত্রাসের প্রতিবাদে শনিবার রাত পর্যন্ত ধর্নায় বসেন সিপিআইএম এবং বিজেপির নেতারা। রবিবার ফের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বসেন তাঁরা। এই নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করার দাবি পেশ করেন। তার পরই নির্বাচন কমিশনার জানান, ফল ঘোষণা স্থগিত থাকছে। তিনি বলেন, তাঁর যে সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছেন, তার বলেই তিনি গণনা স্থগিত রেখেছেন। নির্বাচনে যে সন্ত্রাস হয়েছে, সে কথাও কার্যত স্বীকার করে নেন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়।
শাসকদলের হুমকি
তাঁর সিদ্ধান্তে স্বভাবতই বিরোধী শিবির খুশি এবং বিক্ষুব্ধ শাসকরা। তৃণমূল কংগ্রেস মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বললেন, “বিজেপি-সহ বিরোধীদের চাপে কমিশন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। বিরোধীদের চাপে যদি গণনা স্থগিত থাকে, আমরাও তা হলে প্রতিবাদে কমিশনে গিয়ে অবস্থানে বসব।”
বস্তুত, আজ সকাল থেকেই কমিশনের দফতরের বাইরে ধর্নায় বসেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কয়েক জন শীর্ষ নেতা।
নির্বাচন কমিশনার পুনর্নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করায় পার্থবাবু হুমকি দিয়ে বলেন, নির্ধারিত দিন বুধবারই যদি নির্বাচনের ফল প্রকাশ না করা হয় তবে নির্বাচন কমিশনারকে ঘেরাও করে রাখবেন তাঁরা। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন ইঙ্গিত করেন, রাজ্য বিজেপি-র ভাষায় কথা বলছেন নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, “বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি একটা বিবৃতি দিচ্ছেন আর নির্বাচন কমিশনার সে কথার পুনরাবৃত্তি করছেন!”
মুখ্যমন্ত্রী ভুটানে
সমাজতত্ত্ববিদ অনন্যা চট্টোপাধ্যায় বললেন, “পশ্চিমবঙ্গে এখন এক বিচিত্র পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যে ভোটে শাসকরা এমনিও জিততেন, সেখানেও সর্বাত্মক রিগিং হচ্ছে। আসলে, সব ছোট-বড় নেতাই ভাবছেন, যত দক্ষতার সঙ্গে রিগিং করা যায়, ততই মুখ্যমন্ত্রীর নজরে আসা যাবে।”
কী বলছেন মুখ্যমন্ত্রী? গোটা ঘটনায় তাঁর কোনও প্রতিক্রিয়া এখনও পাওয়া যায়নি। তিনি আপাতত ভুটান সফরে ব্যস্ত। “কী আশ্চর্য! ঠিক যখন পশ্চিমবঙ্গ অশান্তির চরমে, তখনই মুখ্যমন্ত্রী এমন এক দেশে সফর করছেন, যেখানে জাতীয় আয়ের পরিবর্তে জাতীয় শান্তি, খুশির পরিমাপ করা হয়!” বললেন এক নাগরিক। শনিবার বিধাননগরে নিজের ভোটটি দিতে পারেননি তিনি। বুথে পৌঁছে দেখেছিলেন, অন্য কেউ আগেই দিয়ে গিয়েছে তার ভোট।