আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলা চলছেই
2018.08.05
ঢাকা

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে সরকার সমর্থিত ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। পুলিশের উপস্থিতিতে টানা দ্বিতীয় দিনের মতো এ ধরনের হামলা হলো।
এদিকে রোববার রাতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী ড. শহিদুল আলমকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে ডিবি পুলিশের বিরুদ্ধে।
রবিবার ছাত্রলীগের হামলায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তাদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গতকাল রাতে চিকিৎসাধীন ছিলেন ১৪ শিক্ষার্থী।
এ ছাড়া আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৬ জন সাংবাদিক। গত শনিবার আরও ১০ সাংবাদিক আহত হয়েছিলেন। দুইদিনে আহত সাংবাদিকের সংখ্যা ১৬।
পুলিশ, হাসপাতাল এবং আন্দোলনকারিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শনি ও রবিবার—এই দুদিনে সাংবাদিকসহ মোট আহতের সংখ্যা দুই শতাধিক।
শহিদুল আলমকে তুলে নিয়ে যাবার অভিযোগ
খ্যাতিমান আলোকচিত্রী, মানবাধিকারকর্মী ও দৃক গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা ড. শহিদুল আলমকে রোববার রাতে ডিবি পুলিশের পরিচয়ে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে দৃক।
প্রতক্ষ্যদর্শী ও বাড়ির নিরাপত্তারক্ষীদের বরাত দিয়ে ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাত দশটার পর নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকের ৩০-৩৫ জন লোক শহিদুল আলমকে তাঁর ধানমন্ডির বাসা থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়।
তাঁরা যাবার সময় শহিদুল আলমের বাসার দালানের সিসিটিভি ক্যামেরা টেপ করে দিয়ে ফুটেজ নিয়ে যায় বলেও ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজমুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন শহীদুল আলম তাঁদের হেফাজতে নেই।
প্রসঙ্গত, শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন সম্পর্কে রোববার শহিদুল আলামের একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করে কাতারভিত্তি টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরা। ওই সাক্ষাৎকারে শহিদুল আলম আন্দোলন দমানোর নামে শিক্ষার্থীদের ওপর বাংলাদেশ সরকার ও সরকারি দলের দমন পীড়নের সমালোচনা করেন।
রোববারে ঢাকার চিত্র
ররিবার ছিল আন্দোলনের অষ্টম দিন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দিন এক বক্তৃতায় শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
রবিবার ছাত্রলীগের তাণ্ডবের কেন্দ্র ছিল ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও জিগাতলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে। ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা মাথায় হেলমেট পরে রামদা, কিরিচ, রড ও লাঠিসোঁটা বহন করছিল।
শিক্ষার্থীরা ঢাকার ১০টি এলাকায় মূল সড়কে অবস্থান নেয়। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জমায়েত ছিল সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও ধানমন্ডি এলাকায়। গত শনিবারের হামলার প্রতিবাদে এই জমায়েতের ওপর আবার হামলার সময় ঘটনাস্থলে পুলিশ উপস্থিত ছিল।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের মহাসচিব ওবায়দুল কাদের সাংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, ছাত্রলীগ ওই হামলায় সম্পৃক্ত ছিল না।
এদিকে পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ সরদার বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের দিকে আসছিল। তাঁরা নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন।
“হেলমেট পরে লাঠিসোঁটা নিয়ে যারা এসেছে এবং যারা বিক্ষোভ করেছে তাঁদের আলাদা করা যাচ্ছিল না। সে কারণে পুলিশের ওপর যারা ঢিল ছুড়েছে, কেবল তাদেরই নিবৃত্ত করা হয়েছে,” মারুফ সর্দার বেনারকে বলেন।
ঘটনার সূত্রপাত
ধানমন্ডি ৩ নম্বরে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে দুজন ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে এবং চার ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে এমন একটি বার্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার পায় শনিবার। এরপরই নিরস্ত্র স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীরা ধানমন্ডি কার্যালয়ের দিকে ছোটে। সেখানে হামলায় শনিবার প্রায় দেড়শ শিক্ষার্থী আহত হয়।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের ছোড়া ঢিলের আঘাতে আওয়ামী লীগের অন্তত ১৭ জন আহত হওয়ার কথা দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।
স্কুল-কলেজের কিশোর তরুণদের ওপর শনিবারের হামলার প্রতিবাদে গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি ঘোষণা করে। বেলা ১১ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ ও রাজু ভাস্কর্যের সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা নার্সিং কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। পরে তাঁরা বিক্ষোভ মিছিল করে শাহবাগ হয়ে জিগাতলায় যেখানে শিক্ষার্থীরা আহত হয়েছিল সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
বেলা ১২ টার দিকে শিক্ষার্থীরা জিগাতলায় পৌঁছালে পুলিশ তাদের দিকে লক্ষ্য করে টিয়ার শেল ছুড়তে থাকে। শিক্ষার্থীরাও এ সময় পুলিশের দিকে ঢিল ছোড়ে।
দুপুর দেড়টার দিকে রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী ধানমন্ডি ১ নম্বর থেকে পপুলার হাসপাতালের দিকে ছোটেন। তাঁদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরিন প্রমা।
“আমরা ধানমন্ডি ১ থেকে শাহবাগের দিকে যেতে চাইছিলাম। ঠিক সেই সময় ছাত্রলীগের ছেলেরা আমার ওপর হামলা করেছে,” সাদিয়া বেনারনিউজকে বলেন।
সংবাদ সংগ্রহে বাধা
রোববার ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা খুঁজে খুঁজে সাংবাদিকদের পিটিয়েছেন। যাকেই ছবি ও ভিডিও করতে দেখেছেন, তাঁকেই মারপিট করেছেন। গতকাল তাঁদের হামলায় কমপক্ষে ১৬ জন সংবাদকর্মী আহত হন।
এর আগে শনিবার আহত হন ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের পাঁচজনসহ অন্তত ১০ জন সাংবাদিক।
বলপ্রয়োগে সমাধান!
গত ২৯ জুলাই কুর্মিটোলায় শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর থেকে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় বিক্ষোভ করছে। গতকাল বেলা ১২টায় নগরীর জিরো পয়েন্টে ট্রাফিক সপ্তাহের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে।
“বর্তমান পরিস্থিতি ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না,” আসাদুজ্জামান খান বলেন।
শিক্ষার্থীদের ওপর বলপ্রয়োগের ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘ এবং ঢাকার মার্কিন দূতাবাস নিন্দা জানিয়েছে।
এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও কথা সাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমি মনে করি বলপ্রয়োগে কখনই সমস্যার সমাধান হবে না।”
“সরকার বলেছে, তারা শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়েছে, শিক্ষার্থীরা মানতে পারছে না। কারণ প্রতিশ্রুতি দিয়েও পূরণ না হওয়ার ইতিহাস আছে। শিক্ষার্থীরা আস্থা রাখে এমন ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানো সম্ভব,” সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে হামলা
মার্কিন দূতাবাস রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একটি নৈশভোজ শেষে ফেরার সময় শনিবার রাতে একদল সশস্ত্র লোক ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটকে বহনকারী দূতাবাসের একটি গাড়িতে হামলা চালায়। রাষ্ট্রদূত ও তাঁর নিরাপত্তায় নিয়োজিত দল অক্ষত অবস্থায় ঘটনাস্থল ছেড়ে যান। তবে রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা দলের দুটি গাড়ির কিছুটা ক্ষতি হয়েছে।
হামলার ঘটনায় দ্রুত সাড়া দেওয়া এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়িতে হামলাকারীদের শনাক্ত করতে পারেনি মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামাল উদ্দিন মীর বেনারকে বলেন, এখনো কাউকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি, চেষ্টা চলছে।
গত শনিবার রাতে মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের বাসায় নৈশভোজে অংশ নেন মার্শা বার্নিকাট, ড. কামাল হোসেন, তাঁর স্ত্রী হামিদা হোসেন, সুজনের সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন খান। ভোজ শেষে বিদায় নেওয়ার সময় অজ্ঞাতনামা কিছু যুবক বার্নিকাটের গাড়িতে হামলা করে।
নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় অভিযোগ করার কথা বেনারকে জানান ড. আলম, যিনি সরকারের একজন কড়া সমালোচক এবং সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন।