‘আমাদের সন্তানরা প্রমাণ করে দিয়েছে আমরা অযোগ্য, দুর্নীতিগ্রস্ত, ব্যর্থ’
2018.08.07
ঢাকা
সরকার ও জনগণকে নাড়িয়ে দিয়েছে ‘ন্যায় বিচার’ চেয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পরিবহন সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বড় স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনা নজিরবীহিন। এমনটাই জানিয়েছেন স্থানীয় একাধিক বিশ্লেষক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান বেনারকে বলেন, “এই ছাত্র আন্দোলনে সরকার ধাক্কা খেয়েছে, আবার এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনেও ধাক্কা দেওয়া গেছে।”
“সবাই টের পেয়েছে যারা সাধারণ মানুষকে আইনের কথা শোনাবে, তারাই আইনের তোয়াক্কা করে না,” যোগ করেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির এই সাবেক সভাপতি।
ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে গত ২৯ জুলাই নগর পরিবহনের দুটি বাসের রেশারেশির জেরে বাস চাপায় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা দুই শিক্ষার্থী নিহত এবং ১২ জন আহত হওয়ার পর ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ শ্লোগান দিয়ে শুরু হয়েছিল আলোচিত এই আন্দোলন।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “আন্দোলনকারীদের শ্লোগান-প্ল্যাকার্ডের মূল বক্তব্য ছিল, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।”
“এটা মূলত একটা ‘সিমটম’, যা সুবিচারের প্রকাশ্য অভাবে তৈরি হয়েছে। আমাদের দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি আর রাষ্ট্রব্যবস্থার ৪৭ বছরের অপকর্মের ফসল। আসলে এসবের বিরুদ্ধেই এই আন্দোলন।”
গণমাধ্যম বিশ্লেষক আলী আর রাজী বেনারকে বলেন, “যারা এই আন্দোলন শুরু করেছে তারা আমৃত্যু এটা হৃদয়ে বহন করবে। এই আন্দোলন তাদের প্রেরণা যোগাবে প্রতিবাদ করার।”
“এত বড় নেতৃত্বহীন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে আর নাই। সেদিক থেকে সবার জন্যই এটা নতুন অভিজ্ঞতা,” বলেন তিনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষকের দাবি, “আসলে যা ঘটেছে তা ছিল একটা বিপ্লব। এর যা লক্ষ্য ছিল, রাষ্ট্রের দুর্বলতাগুলো রাষ্ট্রের পরিচালকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া, তা অর্জিত হয়েছে।”
“আমাদের সন্তানরা প্রমাণ করে দিয়েছে আমরা অযোগ্য, দুর্নীতিগ্রস্ত, ব্যর্থ। এটাই এই আন্দোলনের সবচেয়ে সড় সাফল্য ও সম্ভাবনার জায়গা,” যোগ করেন তিনি।
সরকারের দমননীতি: সাময়িক সমাধান
গত শনিবার ধানমন্ডি ৩ নম্বরে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে দুজন ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে এবং চার ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে এমন একটি গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার পায়। এরপরই নিরস্ত্র স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীরা ধানমন্ডি কার্যালয়ের দিকে ছোটে। সেখানে হামলায় শনিবার প্রায় দেড়শ শিক্ষার্থী আহত হয়।
এর পর থেকেই আন্দোলনকারীদের ওপর সরকারি দল ও পুলিশের নিপীড়ন বাড়তে থাকে। পাশাপাশি গুজব ছড়ানো ও সহিংসতার অভিযোগে চলতে থাকে গ্রেপ্তার।
তবে এইভাবে দমন পীড়নের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না বিশ্লেষকেরা।
এ প্রসঙ্গে ড. বদিউল বলেন, “দমন পীড়নের মাধ্যমে সমাধান হবে না। হয়ত এটা সাময়িকভাবে দমন করা গেছে।”
তিনি বলেন, “সমস্যার অন্তর্নিহিত কারণ উদঘাটনে সরকারকে নির্মোহ হতে হবে। কারণ মানুষ এখন সচেতন। তাঁরা বুঝতে পারে কী হচ্ছে,” যোগ করেন ড. বদিউল আলম।
“এটা সরকার বিরোধী আন্দোলন, নাকি সরকারই নিজেদের বিরোধী বানিয়ে এটাকে দমন করল, তা নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে,” আন্দোলন দমনে সরকারের কৌশল প্রসঙ্গে বলেন ড. আতাউর।
আতাউরের অভিমত, “সরকার এবং তাঁদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি, উভয়ই আন্দোলনটিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। এ ব্যাপারে কোনো একদলকে দোষ দেয়ার সুযোগ নেই।”
আলী আর রাজী বলেন, “তারা (আন্দোলনকারীরা) রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনাই কেবল দেখেনি, দেখেছে এর ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা। তারা জেনেছে, আন্দোলন প্রতিরোধ করতে কী কী পথ ও উপায় নিতে পারে সরকার।”
“আগামীতে এই সব অভিজ্ঞতা তাদের কর্মপন্থা ঠিক করতেও ভূমিকা রাখবে,” এমনটাই তার প্রত্যাশা।
“এটা বহুদিনের পুঞ্জিভূত অবস্থা,” মন্তব্য করে ড. বদিউল আলম বলেন, “আমাদের রাষ্ট্রে ডাকাত পড়েছে। এই ডাকাতি যদি বন্ধ করা না যায় তবে সাময়িকভাবে হয়ত আন্দোলন দমন করলাম, কিন্তু এটা সমাধান নয়।”
গুজব সব সময় শক্তিশালীর পক্ষে
মেইনস্ট্রিম ও সোস্যাল মিডিয়ায় আন্দোলনকেন্দ্রিক ‘গুজব’ নিয়ে এখনো পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে দুটি পক্ষ। এ ব্যাপারে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার সহকারী অধ্যাপক রাজী বলেন, “গুজব সব সময় শক্তিশালী পক্ষের হাতিয়ার।”
“যার শক্তি বেশি সে গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতি থেকে লাভ তুলে আনতে চেষ্টা করবে- এটা স্বতঃসিদ্ধ। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।”
ড. আতাউর বলেন, “তারা একটি বস্তুনিষ্ট সংবাদকেও গুজব বলবে। হয়ত উদাহরণও দিয়ে দেবে। দুই-তিনজনকে দিয়ে বলাবে এটা ‘অসত্য’। তারপর বলবে সবাই এমন ‘ফেইক নিউজ’ করছে, এটা বেশ সোজা।”
“মাত্র ১০ শতাংশকে ‘বোগাস’ প্রমাণ করা গেলেই বাকি ৯০ শতাংশ সংবাদের ব্যাপারেও মানুষের সন্দেহ তৈরি হবে,” যোগ করেন তিনি।
“রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে রাষ্ট্রকাঠামোর সবগুলো প্রতিষ্ঠান আমরা ধ্বংস করে ফেলেছি। মানুষের কল্যাণে কাজ না করে এগুলো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কল্যাণে কাজ করে,” বলেন ড. বদিউল আলম মজুমদার।
তবে আপাতত স্তিমিত হয়ে এলেও এই আন্দোলন থেকে যে সচেনতনতা তৈরি হয়েছে তা ‘টেকসই’ হবে বলে আশাবাদী নটরডেম কলেজের ছাত্র ফাইয়াজ আহমেদ মাহিন।
সবার মধ্যেই ভীতি
নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে গত তিন দিনে প্রায় দুই শো শিক্ষার্থী আহত হন বলে জানা গেছে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্রে।
তবে অনেকেই পুলিশি ঝামেলা এড়াতে ঘটনাস্থল থেকে দূরে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে তাঁদের সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি।
ওই শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করতে গিয়ে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন। আহতদের অনেকের বয়সই ১৮ বছরের নিচে।
এই আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনের জেরে গত শুক্রবার থেকে সোমবার পর্যন্ত চার দিনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৫০ জন সংবাদকর্মী হামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের সূত্র।
হামলা-ভাংচুরের শিকার হয়েছে একাধিক গণমাধ্যমের ক্যামেরা, গাড়ি, এমনকি একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের অফিসও।
আক্রান্তরা জানিয়েছেন, অধিকাংশ হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছে সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা কর্মীরা।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, পুলিশের উপস্থিতিতেই অনেকগুলো হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও কোথাও সাংবাদিকদের ক্যামেরা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে কিংবা গৃহিত ছবি ও ভিডিওচিত্র মুছে ফেলতে সাংবাদিকদের বাধ্য করা হয়েছে।
এছাড়াও পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা আন্দোলনকারীদের নানাবিধ হয়রানি শুরু করছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক আন্দোলনকারী বেনারকে জানান।
“সবাই আসলে খুব আতঙ্কে রয়েছে,” জানিয়ে নটরডেম কলেজের ছাত্র মাহিন বেনারকে বলেন, “বুধবার সকালে সম্ভবত শেষবারের মতো আমাদের শাহবাগে একত্রিত হওয়ার কথা রয়েছে।”
পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা এবং হামলার শিকার হওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সাংবাদিকরা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দফায় দফায় মানববন্ধন, মিছিল ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে সাংবাদিকরা অত্যাচার নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনাগুলো ‘দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।
“সবার মধ্যেই ভীতি ঢুকে গেছে। কেউই কথা বলতে পারছে না। আমি এটাকে বলি ‘এক্সিস্টেনসিয়ালিস্ট ক্রাইসিস’,” বলেন ড. আতাউর রহমান।
তিনি বলেন, “আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতাও কমে গেছে। সরকার বা রাষ্ট্র যতটুকু চায়, তার চেয়ে বেশি আপনি বলতে পারবেন না।”
এদিকে মার্কিন দূতাবাসের পর গতকাল ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও নরওয়ে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে টার্গেট করে হামলার নিন্দা জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে তাঁরা বলেছে, শিক্ষার্থীরা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারে সমাবেশ ও বাক স্বাধীনতার চর্চা করছিল। তাঁরা আমাদের প্রশংসা ও নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার রাখে। তারা শক্তি প্রদর্শন করেছে, কোনো অশান্তি করেনি।
শহিদুল আলমের চিকিৎসার নির্দেশ
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে মঙ্গলবার আদেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত।
সোমবার পুলিশের করা তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার মামলায় নিম্ন আদালত সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিল শহিদুলের।
চলমান শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রোববার সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেবার পর ওই দিন রাতে তাঁকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ।