অ্যাসিডদগ্ধদের ফ্যাশন শো: ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
2017.03.07
ঢাকা

বরিশালের মেয়ে জেসমিন তখন ১৬ বছরের কিশোরী। প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু সে কারণে ২০০০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর অ্যাসিড হামলা হলো তাঁর ওপর।
উচ্ছল-দুরন্ত জেসমিন শুধু পোড়ার কষ্ট ভোগ করেননি, প্রতিবেশীদের নিন্দামন্দেরও শিকার হলেন। ওইটুকু বয়সে জীবনটাকে শেষ করে দিতে চেয়েছেন বারবার। সেই জেসমিন এতগুলো বছর পর গতকাল মঙ্গলবার অংশ নিয়েছেন একটি ফ্যাশন শোতে।
জেসমিনের মতো ১২ জন নারী ও তিনজন পুরুষ ঢাকার ওয়েস্ট ইনে দেশি-বিদেশি অতিথিদের সামনে র্যাম্পে হেঁটেছেন দৃপ্ত পায়ে। অনুষ্ঠানটির আয়োজক বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইড। কোরিওগ্রাফি করেছেন বিশ্বখ্যাত মডেল বিবি রাসেল। অ্যাকশন এইড গত ১৭ বছর ধরে অ্যাসিডদগ্ধদের নিয়ে কাজ করছে।
অ্যাকশন এইডের এ দেশীয় পরিচালক ফারাহ কবীর বলছিলেন, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাক্কালে সৌন্দর্যের প্রথাগত ধারণাকে ভেঙে দিতে তাঁরা এই উদ্যোগ নিয়েছেন। সংস্থাটি অনুষ্ঠানটির নাম দিয়েছে, ‘বিউটি রিডিফাইনড’ (সৌন্দর্যের নতুন সংজ্ঞা)।
“আমরা কোনো ফ্যান্সি ব্র্যান্ডের প্রসার বা নিজেদের লাভের জন্য এই ফ্যাশন শো এর আয়োজন করিনি। মানুষের ভেতরকার যে শক্তি সৌন্দর্য তা-ই ফুটিয়ে তোলা ছিল আমাদের উদ্দেশ্য,” ফারাহ কবীর বেনারকে বলেন।
অনুষ্ঠানের কোরিওগ্রাফার বিবি রাসেল অংশগ্রহণকারীদের সাহস দেখে মুগ্ধ।
“অ্যাসিডদগ্ধদের নিয়ে বিশ্বের কোথাও আগে এমন কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। আমি এই দলটির সঙ্গে কাজ করতে পেরে গর্বিত। তাদের যে সাহস, তা আমাকে মুগ্ধ করেছে,” বিবি রাসেল বেনারকে বলেন।
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের পর নিজেদের খুশি চেপে রাখতে পারছিলেন না অংশগ্রহণকারীরাও। সামাজিক চাপে যাঁরা নিজেদের সাধারণত লুকিয়ে রাখেন, তাঁরা পাদপ্রদীপের আলোয়, এত এত গুণী মানুষের সামনে র্যাম্পে হাঁটতে পেরে অন্যরকম ভালো লাগার কথা বলেছেন।
১২ জন নারীর পাশাপাশি র্যাম্পে হেঁটেছেন কাসেদ আলী, নূর ইসলাম ও ইমান আলী।
ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ওঁরা ১৫ জন
গতকাল ফ্যাশন শোতে অ্যাসিডদগ্ধ যে ১৫ জন অংশ নেন তাঁরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন বহু বছর ধরে। একটু একটু করে তাঁরা পৌঁছেছেন আজকের এই অবস্থানে।
অ্যাসিডদগ্ধদের একজন নার্গিস বেগম। জমিজমা নিয়ে কোন্দলের জেরে অ্যাসিড হামলার শিকার হন ২০১৪ সালে। এমনভাবে বিকৃত হয়েছে চেহারা, অনেকে দেখলে এখন আর চিনতে পারেন না। বলছিলেন, স্বামী চান তিনি যেন কারও সামনে বের না হন। কিন্তু তিনি বেরিয়েছেন। একটি/দুটি করে টাকা জমিয়ে এখন পশুপালন করছেন। এখন ৮০ হাজার টাকার মালিক।
আমিনা খাতুন নিলার বিয়ে হয়েছিল ১৯ বছর বয়সে সৌদি আরব প্রবাসী এক যুবকের সঙ্গে। বিয়ের কয়েক সপ্তাহের মাথায় স্বামী অ্যাসিড ছোঁড়েন। কিন্তু আমিনা থেমে যাননি।
“যার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল, সে খুব বদরাগী ছিল। কিন্তু সে যে অ্যাসিড ছুঁড়ে বসবে তা ভাবিনি। এখনো আমি এ প্রশ্নের জবাব পাইনি,” আমিনা বেনারকে বলেন। তিনি একরকম ঘরবন্দী হয়েছিলেন। সিরাজগঞ্জের মেয়ে আমিনা শেষ পর্যন্ত জীবনের প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। স্নাতক পাস করে এখন চাকরি খুঁজছেন।
গঙ্গাদাসী (৪০) অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছিলেন ১৭ বছর বয়সে বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ায়। হতাশায় ডুবেছিলেন। এখন ব্যবসা করে নিজের পায়ে নিজেই দাঁড়িয়েছেন।
র্যাম্পে হাঁটার পর অংশগ্রহণকারীরা বলেন, এমন একটা দিন তাঁদের জীবনে আসবে তাঁরা কল্পনাও করেননি। আগে থেকেই তাঁরা এনজিওর সঙ্গে যুক্ত। তবে র্যাম্পে হাঁটার আমন্ত্রণ পেয়ে প্রথমে একটু দ্বিধান্বিত হয়েছিলেন। পরে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
অ্যাসিডদগ্ধরা কাঁদিয়েছেন উপস্থিতিকে
১৭ দিন বয়সে অ্যাসিডদগ্ধ সোনালীকে আনা হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে। সেই সোনালীর অস্ত্রোপচার হয়েছে আটবার। এখন সে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সাতক্ষীরার তালার মেয়ে সোনালীর সঙ্গে গ্রামের যেকোনো দুরন্ত কিশোরীর কোনো পার্থক্য নেই।
গতকাল সোনালী বলছিল, আকাশ ছোঁয়ার সাধ তার।
“র্যাম্পে হাঁটতে পেরে খুশি। আমি আরও বহুদূর যেতে চাই। আমি চিকিৎসক হব, এই চিকিৎসকেরাই আমাকে বাঁচিয়েছেন,” অনুষ্ঠানে জানায় সোনালী।
সেই ১৭ দিন বয়স থেকে সোনালীর চিকিৎসা করেছেন বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন।
“আমার আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। সেই সোনালী যে এই সোনালী আমি ভাবতেই পারছি না। আমি এখানে এসে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর এক কিশোরীকে দেখলাম,” সামন্তলাল সেন অনুষ্ঠানে বলেন।
জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফাও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন।
“এত চ্যালেঞ্জ নিয়ে ওরা এতটা দূর এসেছে...আমরা সব থাকার পরও কত কিছু নিয়ে কমপ্লেইন (অনুযোগ) করি। আজ থেকে আর কোনো কিছু নিয়ে কমপ্লেইন করব না আমি,” সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন।
অ্যাসিড সন্ত্রাস এখনো বড় সমস্যা
অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন বলছে, দেশে অ্যাসিড হামলার সংখ্যা আগের তুলনায় কমে এসেছে। তবে বন্ধ হয়নি। ২০১৫ ও ১৬ সালে অ্যাসিড হামলার সংখ্যা ছিল ৭৪টি। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ হামলার শিকার হন ২০০২ সালে। ওই এক বছরে ৪৯৬জন অ্যাসিড হামলার শিকার হন।
তবে সমস্যা হলো এখনো পর্যন্ত এই হামলায় বিচার হয়েছে খুব কম। অ্যাসিড হামলার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে গত ১৫ বছরে ১৪ জন আসামির মৃত্যুদণ্ড হলেও, এখনো একটিও কার্যকর হয়নি। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে ১১৮ জনের। নানা কারণে খালাসও পেয়েছেন দেড় হাজারের ওপর আসামি। বিচার নিশ্চিত করা না গেলে অ্যাসিড সন্ত্রাসের মতো ভয়াবহ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ অ্যাসিডদগ্ধদের নিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো ফ্যাশন শোর আয়োজন করেছে। ফ্যাশন শোটি পরিচালনা করছেন বিবি রাসেল। অ্যাসিডদগ্ধ ব্যক্তিরা হলেন অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের সহায়তায় অ্যাসিডদগ্ধদের নিয়ে গঠিত নেটওয়ার্ক ‘সেতুবন্ধন গড়ি’র সদস্য।
বিবি রাসেল বললেন, “মাত্র তিনবারের মহড়ায় এই মানুষগুলো যা করেছেন, আমি সত্যিই অভিভূত।”